বিদ্রোহীদের কাছে একের পর এক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সামরিক জান্তা। প্রতিদিন সেনা ঘাঁটি হারাতে হারাতে নিজেদের ক্ষমতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে এ সরকারের ক্ষমতায় থাকা এ বাহিনী।
বিবিসির ‘মিলিট্যান্ট বৌদ্ধ ভিক্ষুর আগুনের মুখোমুখি- হেরে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। যেখানে এ তথ্য দেওয়া হয়।
সাংবাদিক জোনাথন হেড’র করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাউক কো তাও নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর আগুনের মুখোমুখি হয়েছে মিয়ানমার সেনা। তার চমৎকার পরামর্শ শুনতে পাহাড়ি শহর পাইন ও লুইনের প্রধান চত্বরে গত মঙ্গলবার কয়েকশ মানুষ জমায়েত হয়েছিল। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এ বৌদ্ধভিক্ষু সেখানে বলেন, জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের উচিৎ নিজ পদ থেকে সরে যাওয়া। তার স্থলে ক্ষমতায় আসা উচিৎ ডেপুটি জেনারেল শয়ে উইনের।
পাউক কো তাও অবশ্য এর আগে সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে ধারাবাহিকভাবে পরাজিত হতে শুরু করে সামরিক জান্তা। ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র চাপে পড়ে মিয়ানমারে। নানা দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা আসতে শুরু করে। মিন অং হ্লাইংয়ের এক সময়কার ‘চিয়ারলিডার’রাও নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা শুরু করেন। সামরিক জান্তার ভূমিকার কড়া সমালোচনা শুরু করে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও।
বৌদ্ধ ধর্মের উগ্র-জাতীয়তাবাদের ভিক্ষু পাউক কো তাও মঙ্গলবার জেনারেল শয়ে উইনের প্রশংসা করে ওই জমায়েতে বলেন, তার দিকে চেয়ে দেখুন। প্রকৃত একজন সেনার মুখ। মিন অং হ্লাইং পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না। বেসামরিক ভূমিকায় চলে যাওয়া উচিত তার।
মিয়ানমারের সেনা বাহিনীতে মিলিট্যান্ট বৌদ্ধ ভিক্ষু পাউক কো তাও’র সমর্থন কেমন, সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু তার মন্তব্য অন্য জান্তা সমর্থকদের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয়, যারা মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জোয়ার ফেরাতে অক্ষম। তারা দেখছেন, সামরিক নেতারা বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইয়ে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। এতে হতাশা বেড়ে চলেছে।
সাংবাদিক জোনাথন হেড তার প্রতিবেদনে বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেশ পুরনো। মিয়ানমারের রাজনীতিতে ভিক্ষুদের ভূমিকা রাখার দীর্ঘ রীতি আছে। ২০২১ সালে ঘটনা সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতাও করেন কোনো কোনো বৌদ্ধ ভিক্ষু। নিজেদের প্রচলিত পোশাক ছেড়ে তারা জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন।
অবশ্য তাদের কয়েকজন সেনাবাহিনীর জেনারেলদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। তারা নিজেদের মধ্যে (ভিক্ষু ও সেনা) বিশ্বাস স্থাপন করেন যে বাইরের প্রভাব থেকে বৌদ্ধধর্ম ও বার্মিজ সংস্কৃতি উভয়কেই রক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ হয়েছিল।
সহিংস এ সংঘর্ষের পর উইরাথু নামে এক সন্ন্যাসী মা বা থা নামে আন্দোলন বা জাতি ও ধর্ম রক্ষার জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। এটি মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা বয়কটকে উৎসাহিত করে, দাবি করে যে বার্মিজ বৌদ্ধধর্ম মুসলমানদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ, এই মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ।
২০১৭ সালে ‘মা বা থা’ আন্দোলন নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু তারপরও সেনাবাহিনী তাদের পক্ষ থেকে সমর্থন পেয়ে আসছিল। উল্লেখ্য, সন্ন্যাসী উইরাথুকে জাতিগত সংঘাতে উস্কানি দেওয়ার কারণে জেলে পোরা হয়েছিল। ২০২০ সালে তাকে আবার জেল দেওয়া হয়; কিন্তু এ বছরের কমসময়ের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাকে জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইং সম্মান ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন। পরে উইরাথুর এক অনুসারী ওয়াথাওয়া সাগাইং রাজ্যে সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ সৃষ্টিতে সহায়তা করেন।
সম্প্রতি জাতিগত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লজ্জাজনকভাবে হারতে শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিদ্রোহীরা উত্তরের শান রাজ্যের বিশাল এলাকা তাদের দখলে নিয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিদ্রোহীরা অভিযান শুরু করে। তীব্র হয়ে ওঠে লড়াই। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এতে সামরিক জান্তা ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক উপায়ে মিয়ানমারে নির্বাচিত হয়ে সরকার চালাচ্ছিলেন অং সান সুচি। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা মিন অং হ্লাইং।