অপরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থার কারণে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে। দিন দিন এই শহরের জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে।এখনই যানজট হ্রাসে উদ্যোগ গ্রহণ করা না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তবে গণপরিবহন তথা বাস, রেল ও নৌ-পথে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে একটি বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত ও জনবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলে তিন বছরেই ঢাকার যানজট দূর করা সম্ভব।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘যানজটের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। এতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৮ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।
বক্তারা বলেন, অপরিকল্পিত নগর পরিবহন ব্যবস্থার কারণে ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম যানজট প্রবণ নগরে। ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২৩০-২৫০ মিলিয়নে পৌঁছবে। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় অংশ ঘটবে শহরাঞ্চলে। যানজট হ্রাস, বাস, রেল ও নৌপথে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে একটি বহুমাধ্যমভিত্তিক সমন্বিত ও জনবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা ব্যক্ত করেন বক্তারা।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের কর্মসূচি প্রধান সৈয়দা অনন্যা রহমানের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং ট্রাফিক সিগনাল সিস্টেম গবেষক ও ট্রাফিক্সের সিইও আশরাফুল আলম রতন। এতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান, আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম, ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের টেকনিকাল অ্যাডভাইজর আমিনুল ইসলাম সুজন, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের নির্বাহী সদস্য মারুফ হোসেন, প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ।
সাইফুদ্দিন আহমেদ তার প্রবন্ধে বলেন, ২০০৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। ঢাকায় যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে দৈনিক প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা। অর্থমূল্যে যা দৈনিক প্রায় ১৩৯ কোটি এবং বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার অধিক। যানজটের এই সমস্যার জন্য শৃঙ্খলা না মেনে গাড়ি চালানো, রাজধানীর বিভিন্ন ব্যস্ত সড়কে মেগা প্রকল্পগুলোর কালক্ষেপণ, ব্যক্তিগত গাড়ি নির্ভর পরিকল্পনা, দুর্বল ট্রাফিক সিগনাল ও মনিটরিং ব্যবস্থা, যানবাহন নিবন্ধনে অব্যবস্থাপনা, সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক পদ্ধতির অভাবসহ বেশ কিছু কারণ দায়ি। এ বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সমাধান করা গেলে সড়কে গতি ও শৃঙ্খলা ফিরতে পারে।
আশরাফুল আলম রতন তার প্রবন্ধে বলেন, ঢাকা শহরের ট্রাফিক সিস্টেম অকার্যকর হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে হাত-লাঠি নির্ভর সিগনাল সিস্টেম, সিগনালে যানবাহনের পারাপারের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, যানজট সৃষ্টি হতে পারে এমন স্থানে গাড়ি পার্কিং করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, আইনের প্রতি সম্মান ও বাধ্য না থাকা, চালকের নিয়মিত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক না করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমরা স্বনির্বাচনযোগ্য সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বা Customizable Integrated Traffic Management System (CITMS) প্রস্তাব করছি। এর মাধ্যমে সারা বছর ২৪ ঘণ্টা সিগনাল অপারেশন চলমান রাখা, গাড়ির গড় গতি ২৫-৩০ কিলোমিটারে ফিরিয়ে আনা, আইন ভঙ্গকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা, পথচারীদের যাতায়াতে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, আন্তঃবিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন, দূষণকারী বাহন চিহ্নিত করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদন সম্ভব হবে।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের এখন সংস্কার দরকার। এই সংস্কার করতে হলে ট্রাফিক ব্যবস্থারও সংস্কার দরকার। যানজটের অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি দরকার। আমাদের বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল কোনো একটি টক-শোয় বলেছিলেন, উনাকে দায়িত্ব দিলে পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার যানজট দূর করে দেবেন। এখন তো উনারাই আমাদের এই দায়িত্বগুলোয় আছেন। আসলে ঢাকার যানজট দূর করে তিন বছরই যথেষ্ট। এজন্য প্রায়োরিটি ঠিক করে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা বলতে চাই আমাদের সরকার আছে, আমাদের এখানে যে সংগঠনগুলো আছে, সেগুলো আবেগ দিয়ে কাজ করে, স্বার্থ দিয়ে কাজ করে না। উনাদের কাছে আসেন। দেশের ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানিং চাপিয়ে দেওয়া বাদ দিয়ে মানুষের জনমত নিয়ে কাজ করি। জাপান-আমেরিকা করার প্রয়োজন নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করি। তাহলে তিন বছরের মধ্যে ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম দূর কর সম্ভব। সেজন্য ঢাকার ওপর কন্ট্রোল আনতে হবে৷ ঢাকায় ৩ কোটি মানুষের পরিকল্পনা করে কয়েক বছর পরে ৬ কোটি মানুষ নিয়ে এলে সেটা হবে না। কিছু গণপরিবহন, কমিউটার ট্রেন নামাতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য বক্তারা বলেন, গণপরিবহনের সিটি সার্ভিস এবং অন্যান্য সার্ভিসের জন্য পৃথক নীতিমালা, সহায়ক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। প্রকল্প ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাজ করার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যানজট হ্রাসে সফলতা আসেনি। ট্রাফিকদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন, যেন তারা অন্তত পাঁচ বছর একাধারে কাজ করতে পারে। দেশিয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প খরচে ট্রাফিক সিস্টেমের সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। সড়ক পরিবহন আইনটি পূর্ণাঙ্গ নয়। এই আইনের সংশোধনে কাজ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শহরের পরিবহন পরিকল্পনায় নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
সংবাদ সম্মেলন থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমাধানে ফিটনেসহীন বাস অপসারণ, গণপরিবহনের মান উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য পৃথক বাস প্রচলন, রাস্তায় একদিন জোড় এবং একদিন বিজোড় সংখ্যার ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ডিটিসিএর মাধ্যমে সমন্বিত মনিটরিং কমিটি/টাস্কফোর্স কমিটি গঠন এবং নিয়মিত মনিটরিং করা, রাস্তায় অবৈধ পার্কিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, নগর পরিবহনের জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সড়কে যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামা বন্ধ করা, সায়েদাবাদ, গাবতলী এবং মহাখালী আন্ত-টার্মিনাল সংযোগ তৈরি, নগরীর ট্রাফিক রুট পুনর্বিন্যাস, সড়ক ব্যবস্থাপনায় অধিক গুরুত্বারোপ, প্রধান সড়ক থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশা প্রত্যাহার, যানজট নিরসনে স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বিআরটিসিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে একক কোম্পানির মাধ্যমে নগরের বাস পরিসেবা চালু করাসহ ১৮ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।