ভালো বেতন হবে, জীবন হবে উন্নত। কিন্তু একটু কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩ ঘণ্টার পানি পথ পানি দিতে পারলেই ইতালি।এমন আশ্বাস দিয়ে চারজন যুবকের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নেয় ইতালি প্রবাসী টোকনের পরিবারের কাছে।
মানব পাচারকারী টোকন ভুয়া ভিসা দিয়ে চার যুবককে গত ৩০ জুন লিবিয়া নিয়ে একটি নির্জন কক্ষে প্রায় চার মাস আটক রেখে নির্যাতন করে। পরে ভিডিও কলে এই নির্যাতন দেখিয়ে চার যুবকের পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে আরও প্রায় ৯৬ লাখ টাকা।
জানা যায়, চার যুবকের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে দেওয়া হয় ইতালির ভিসা, এমনকি বিমানের টিকিটও অগ্রিম কাটা হয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনে গিয়ে যুবকেরা জানতে পারেন সবই ভুয়া। দালালদের প্রলোভনে পড়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়ে সর্বস্বান্ত তাদের মত অনেকেই।
এদিকে চার যুবকের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের হোতা ইতালি প্রবাসী টোকনের বিচার দাবি করেছেন ভুক্তভোগীসহ এলাকাবাসী।
মুঠোফোনে কথা হয় তার নিজ গ্রাম গাংনী উপজেলার শালদহ এলাকার খবির উদ্দীনের ছেলে স্বপন আলী, ইউসুব আলীর ছেলে কামরুজ্জামান, খলিলুর রহমানের ছেলে সামিউল্লাহ ও পার্শ্ববর্তী আলমডাঙ্গা উপজেলার বড়গাংনী গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের ছেলে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে।
ভুক্তভোগী স্বপন ও কামরুজ্জামান জানান, কোনো ঝামেলা ছাড়াই তাদের ইতালি পৌঁছে দেওয়া হবে, এমন শর্তে টোকনের ভাই আনোয়ার হোসেন আনুর ছেলে আকাশের হাতে তুলে দেওয়া হয় চারজনের ছয় লাখ টাকা। পাসপোর্টে দেওয়ার পর তারা ইতালির ভিসা, একই সঙ্গে কেটে দেয় বিমানের টিকিটও।
গত ৩০ জুন ইতালির উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ভারতের চেন্নাই, তারপর শ্রীলঙ্কা হয়ে দুবাই নিয়ে যায়। দুবাইয়ে একটি হোটেলে তিন দিন রাখে। তারপর মিশর হয়ে নিয়ে যায় লিবিয়ায়। পরে লিবিয়া একটি স্থানীয় বিমান বন্দরে আমাদের নামিয়ে দেন। সেখান থেকে গাড়িতে করে চার দিনের পথ পেরিয়ে নিয়ে যায় ত্রিপুর নামে একটি পাহাড় এলাকায়। নির্জন পাহাড়ের ওপর একটি গোডাউনে পৌঁছে দেয় আমাদের। ওই গোডাউনে আমাদের মত আরও ৫০/৬০ জন অবস্থান করছেন। ওখানে গিয়েই জানতে পারলাম আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। তিনি জানান, টাকার লেনদেন টোকনের বাড়িতে বসেই হয়।
ভুক্তভোগী স্বপন আলী বলেন, আমাকে ইতালি পাঠানো হবে এ প্রলোভনে পড়ে আমি প্রতারিত হই। আগে বুঝতে পারিনি, তাহলে এই ফাঁদে পা দিতাম না। আমার কাছ থেকে ২৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়েছে টোকনের ভাইস্তা আকাশ। আমি আমার টাকা ফেরত চাই, আর এ দালালচক্রের বিচার চাই।
আরেক ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, টোকনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আমিসহ তিন যুবক সর্বস্বান্ত হয়েছি। কেউ সুদে টাকা এনে, কেউ এনজিও থেকে ঋণ এনে তাকে ৯৬ লাখ টাকা হাতে তুলে দিয়েছে এ প্রতারকদের। এখন ইতালিও নিতে পারছে না, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। এর একটা প্রতিকার দরকার। এ দালালদের বিচারও হওয়া দরকার। প্রশাসনের কাছে জোর দাবি, এই চক্রকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টোকনের মূল পাটনার ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার কামারডাঙ্গা গ্রামের ওহিদুর রহমান। তার এলাকায় তাকে রহমান নামে চেনে। এই চক্রের আরেক সদস্য ফরিদপুরের তৌহিদুল ইসলাম।
ভুক্তভোগীরা আরও জানায়, পানি পথে ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার একটা আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র কাজ করছে। বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের লোক রয়েছেন। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের লোকজন সব ঠিকঠাক করে দেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ’ এর গাংনী এরিয়া সমন্বয়কারী হেলাল উদ্দীন বলেন, লোভে পড়েই বারবার প্রতারিত হচ্ছেন এলাকার শত শত যুবক। এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে, প্রশাসনের উচিত বিষয়গুলো নজরে এনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
এ বিষয়ে জানতে টোকনের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। ওই চার যুবক দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে বাবার বাড়ি। তবে, তার মা শাহিদা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, এই বাড়ি আমার। আমার ছেলে ওই চার যুবককে নিয়ে গেছে। তারা লিবিয়া থেকে জোর করেই ফিরে এসেছে। ফেরার আগে আমাদের কাছে লিখিত দিয়েছে তারা আইনি কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তবে, আরেক অভিযুক্ত টোকনের ভাইস্তা আকাশ পালিয়ে গেছেন।
এলাকাবাসী জানান, টোকন এক সময় তার ভাইদের সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে জীবন ধারণ করলেও এখন সে গ্রামেই ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন।
সরেজমিনে শালদহ গিয়ে দেখা গেছে, তার বাড়ির নাম দিয়েছেন ‘টোকন আলিশান বাড়ি’। এদিকে প্রতারিত চার যুবক আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রশাসন বলছে, এমন ঘটনা থামাতে জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার পাশাপাশি প্রয়োজন পরিবারেরও সচেতনতা।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বানী আমিন বলেন, এমন ঘটনায় আদালতে দায়ের করা একাধিক মামলা তদন্ত করছে পুলিশ। এছাড়া, প্রত্যেকটি মামলা নিখুঁতভাবে তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। অনেকেই গ্রেপ্তারও হয়েছে। বেকার যুবকেরা সচেতন হলে এসব প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। সচেতনতার বিকল্প কিছুই নেই।