এই মেয়াদে কেমন হবে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি

এই মেয়াদে কেমন হবে এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি

চরম বিভক্তি ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক নির্বাচনে জিতে তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। শনিবার তিনি শপথ নিয়েছেন। এই মেয়াদেও তাঁর সরকার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির দিকেই হাঁটবে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক সংঘাতে যত কম জড়ানো যায়, সে প্রচেষ্টা থাকবে।

একাধিক সূত্র এরদোয়ানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা হলো দেশটির মিত্রদের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা; বড় ধরনের কূটনৈতিক সংকট ঠেকানো; সিরিয়া, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এবং সর্বোপরি স্বাধীন নীতি বজায় রাখা।

আঙ্কারাভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের পররাষ্ট্রনীতি গবেষণার প্রধান মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, ‘তুরস্ক বৈশ্বিক ভূমিকা পালনকারী বা শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করছে। প্রতিটি সংঘাত বা ইস্যুতে দেশটির একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ—সেটাই ইঙ্গিত করে।’

এই প্রবণতা দেখা যায় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে সিরিয়ার কুর্দি গোষ্ঠীগুলো ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বিষয়ে নেওয়া দেশটির অবস্থানে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মাঝেমধ্যেই তুরস্ককে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

বিগত দশকটিতে প্রায়ই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। এখন তুরস্কের কর্মকর্তাদের সাধারণ একটি উপলব্ধি হলো কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানো হয়েছে, ভবিষ্যতে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর প্রচেষ্টা থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে বলেন, আগামী পাঁচ বছরে তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে, সে ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনীতিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এরপরও তুরস্ককে যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, তা আগে থেকেই ধারণা করা যায়।

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক

জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে গঠিত বৈশ্বিক জোটে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিশেষ দূত জেমস জেফারি গত সপ্তাহে বলেছেন, ‘তুরস্ক স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করে যাবে।’ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই স্বাধীন অবস্থান খুবই স্পষ্ট:

প্রথমত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনকে ন্যাটোতে গ্রহণ করার বিনিময়ে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে দেশটির কাছ থেকে বেশ কয়েকজন তুর্কি নাগরিককে প্রত্যর্পণে তুরস্কের অনড় দাবি।

দ্বিতীয়ত, উত্তর-পূর্ব সিরিয়া নিয়ন্ত্রণকারী কুর্দি সংগঠন পিওয়াইডিকে সমর্থন দেওয়া বন্ধে অব্যাহতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে আঙ্কারা। পিওয়াইডিকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সিরীয় শাখা হিসেবে দেখে আসছে তুরস্ক। সশস্ত্র গোষ্ঠী পিকেকে এক দশক ধরে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে।

তৃতীয়ত, এরদোয়ান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইউক্রেনে হামলা চালানোয় মস্কোর ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন তিনি। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের কাছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রি বিলম্বিত করছে।

হুররিয়েত ডেইলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও এরদোয়ানের মধ্যে সাম্প্রতিক ফোনালাপে এফ-১৬ চুক্তি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহের কথা জানান বাইডেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের অনুমোদন এই চুক্তির পূর্বশর্ত।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর মধ্যে রয়েছে সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের পদক্ষেপ, ২০১৬ সালের শরণার্থী চুক্তি এবং তুরস্ক ও গ্রিসের সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা।

এরদোয়ান ইইউর সঙ্গে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা এবং শরণার্থীদের ইউরোপে পৌঁছানো ঠেকাতে সম্পাদিত চুক্তি বহালের বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

মুরাত ইয়েসিলতাসের মতে, তুরস্ক সম্ভবত জুলাইয়ে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনের সময় পশ্চিমা এই সামরিক জোটে সুইডেনের সদস্যপদ প্রস্তাবে অনুমোদন দিতে পারে। অবশ্য তিনি আশা করেন, সুইডেনও তাদের সীমানায় পিকেকে সমর্থকদের তুরস্কবিরোধী বিক্ষোভ ঠেকাতে পদক্ষেপ নেবে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন

শুরু থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ পথ অবলম্বন করে আসছে তুরস্ক। একদিকে আঙ্কারা ইউক্রেনের কাছে সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করছে, অন্যদিকে রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ থেকে বিরত রয়েছে।

এ ছাড়া কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো থেকে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির সুযোগ করে দিতে তুরস্ক ও জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি আঙ্কারার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

তুরস্কের কয়েকজন কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ তুরস্কের এই নীতি বজায় রাখার পক্ষে। কারণ, এটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের মাধ্যমে মস্কোর সঙ্গে তাদের (ইইউ) আলোচনায় যুক্ত থাকার সুযোগ করে দেবে।

এরপরও নাগোরনো-কারাবাখ, সিরিয়া, লিবিয়াসহ কয়েকটি ইস্যুতে আঙ্কারা ও মস্কোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা

এ দুটি অঞ্চলের গণজাগরণের কড়া সমর্থক ছিল তুরস্ক। আরব বসন্তের হাত ধরে গঠিত লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও মিসরের সরকারকে সমর্থন দেয় দেশটি। অনিবার্যভাবে এটি আঙ্কারা ও উপসাগরীয় দেশগুলোকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। এসব দেশ বিভিন্ন প্রতিবিপ্লবকে সমর্থন দিয়েছিল।

অবশ্য মিসর, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন এরদোয়ান। আবুধাবি ও রিয়াদের সঙ্গে কয়েক শ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক চুক্তি সই করেছে আঙ্কারা। পাশাপাশি তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৫০০ কোটি ডলার জমার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে।

মুরাত ইয়েসিলতাসের মতে, আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ফলে শুধু তুরস্কই লাভবান হবে না, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবও লাভবান হবে। তাঁর যুক্তি, ‘আমরা এখন এমন একটি সময়ে প্রবেশ করছি, যেখানে ভূরাজনীতির চেয়ে ভূ-অর্থনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে।’ এ ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধা নিতে চায় আমিরাত ও মিসরের মতো এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো।

মে মাসে মস্কোয় সিরীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে তুরস্কের প্রতিনিধিদল। যদিও সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পরপরই ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS