ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদের ‘স্বপ্ন’ কতটা বাস্তবসম্মত?

ট্রাম্পের তৃতীয় মেয়াদের ‘স্বপ্ন’ কতটা বাস্তবসম্মত?

সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রোববার ট্রাম্প বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ‘মজা করছেন না’।

এনবিসি নিউজের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি সত্যিই এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন কি না। তখন ট্রাম্প বলেন, এর জন্য কিছু পদ্ধতি রয়েছে। একটি উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি নিজেই।

এর মধ্যে একটি হতে পারে, ২০২৮ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স প্রার্থী হয়ে জিতবেন এবং পরে পদত্যাগ করবেন, যেন তিনি (ট্রাম্প) দায়িত্ব নিতে পারেন। ট্রাম্প বলেন, কিন্তু আরও উপায় আছে। অনেক মানুষ চায় আমি এটি করি। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি প্রেসিডেন্ট।

এই মন্তব্যে উদ্বেগ ও নানা জল্পনা-কল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। কেননা, এমন ধারণা এবারই প্রথম সামনে আনেননি ট্রাম্প। তাহলে তিনি কি সত্যিই এমনটি করতে পারেন? কোনো বিকল্প কি রয়েছে?

ট্রাম্প কি এর আগেও তৃতীয় মেয়াদের ইঙ্গিত দিয়েছেন?

ট্রাম্প বারবারই প্রেসিডেন্টের দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ফ্লোরিডায় তহবিল সংগ্রহের এক অনুষ্ঠানে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনির্দিষ্টকালের শাসনের প্রসঙ্গ টেনে মজা করে বলেছিলেন, ‘হয়তো আমরাও একদিন এটি চেষ্টা করতে পারি। ’

নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ট্রাম্প বলেন, সমর্থকেরা তার তৃতীয় মেয়াদ চাইতে পারেন। একবার তিনি এটিকে ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, কারণ তাকে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

২০২০ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘যতদিন না মানুষ ঠিকভাবে, নিরাপদে এবং সুরক্ষিতভাবে ভোট দিতে পারে, ততদিন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া উচিত। ’ এই মন্তব্য আবারো আশঙ্কা তৈরি করেছিল, তিনি মেয়াদ শেষের পরও ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে পারেন।

ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন বলেন, ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অস্বাভাবিক উপায় অনুসন্ধান করেছেন। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ব্যানন ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ট্রাম্প ২০২৮ সালে আবার প্রার্থী হবেন এবং জয়ী হবেন।

‘আমি মনে করি, তিনি ২০২৮ সালে আবার প্রার্থী হবেন এবং আমার ধারণা তিনি জিতবেন,’ বলেন ব্যানন। ট্রাম্প কীভাবে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেন- এমন প্রশ্ন নিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি, কিছু বিকল্প থাকবে।

কী আছে আলোচিত ২২তম সংশোধনীতে?

১৯৫১ সালে অনুমোদিত মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনী বলছে, কোনো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদে দুইবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না।  

সোজা কথায় একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। কিন্তু কিছু ট্রাম্প সমর্থকের কথা হলো, এই সংশোধনী একটি ব্যাখ্যার সুযোগ রেখেছে। সেটি হলো, নির্বাচন না করেও উত্তরাধিকারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব।

ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের আগে কোনো প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি চারবার নির্বাচিত হন এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  

পরে আইনপ্রণেতারা ২২তম সংশোধনী পাস করার উদ্যোগ নেন, যা ১৯৫১ সালে অনুমোদিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দুই মেয়াদের ঐতিহ্যকে আইনি রূপ দেওয়া এবং ভবিষ্যতে কোনো প্রেসিডেন্টকে দুই মেয়াদের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে না দেওয়া।

ট্রাম্প ২২তম সংশোধনীকে কীভাবে উপেক্ষা করতে পারেন?

সর্বাধিক আলোচিত একটি ফাঁক হলো ২০২৮ সালে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা। যদি কোনো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং পরে পদত্যাগ করেন, মৃত্যুবরণ করেন কিংবা অফিস থেকে অপসারিত হন, তবে তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন।

এই ধারণা ২২তম সংশোধনীর একটি সংকীর্ণ ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই সংশোধনী কোনো ব্যক্তিকে দুইবারের বেশি নির্বাচিত হওয়া থেকে বাধা দেয় – তবে দুই মেয়াদের বেশি শাসন করা থেকে নয়। এই তত্ত্বের সমর্থকেরা বলেন, সংশোধনীটি হয়তো ট্রাম্পকে উত্তরাধিকার হিসেবে প্রেসিডেন্ট হতে বাধা দেবে না।

ব্রুস ফেইনসহ কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ এই ধারণাটিকে বাস্তবসম্মত মনে করেন না। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘২২তম সংশোধনী এড়ানোর জন্য কোনো সাংবিধানিক উপায় নেই। ’

ফেইন সতর্ক করে বলেন, যদি ট্রাম্প ২২তম সংশোধনী মানতে না চান, তবে তিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য অন্য কোনো সীমাবদ্ধতাও আর মেনে চলতে চাইবেন না।

তিনি বলেন, ট্রাম্প সংবিধানকে নষ্ট করে নিজেকে নেপোলিয়নের মতো রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করতে চান, যেমন নেপোলিয়ন ১৮০৪ সালে নিজেকে সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন।  

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, যদি ট্রাম্প ২২তম সংশোধনী উপেক্ষা করেন, তবে তিনি আদালতের আদেশ ভঙ্গ করতে কোনো দ্বিধা করবেন না… তিনি সেনাবাহিনীকে ডাকতে পারেন বিচারক, আইনপ্রণেতা, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আটক এবং কারাগারে পাঠানোর জন্য।

কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, ২২তম সংশোধনীকে ফাঁক হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ওপর একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে, সেটি হলো ১২তম সংশোধনী।

১২তম সংশোধনীতে কী আছে?

১২তম সংশোধনী বলছে, যিনি প্রেসিডেন্ট পদে সাংবিধানিকভাবে অযোগ্য, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রেও অযোগ্য। সোজা কথা, যদি ট্রাম্প দুই মেয়াদ পূর্ণ করার পর আর প্রেসিডেন্ট হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হন, তবে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টও হতে পারবেন না।

ফেইন বলেন, ১২তম সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হতে পারবেন না, কারণ তিনি প্রেসিডেন্ট পদেই অযোগ্য হবেন। সেক্ষেত্রে আদালত ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতাকে সাংবিধানিক উদ্দেশ্যের সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে দেখতে পারেন।

২২তম সংশোধনী বাতিল বা পরিবর্তন করা সম্ভব?

তত্ত্বগতভাবে এই প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ। তবে এটি অত্যন্ত অসম্ভব কাজ।  

২২তম সংশোধনী বাতিল করতে আরও একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে। হাউস ও সিনেট— দুটি কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন, তারপর ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ অঙ্গরাজ্যের আইনসভার (৩৮টি রাজ্য) অনুমোদন লাগবে।

বর্তমানে মাত্র ২৮টি অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রিপাবলিকানদের, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। কংগ্রেসে ট্রাম্পের দল কোনো একটি কক্ষে বা দুটোতেই প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পায়নি।

ট্রাম্পের আবারো প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো উপায় আছে কি?

টেকনিক্যালি হ্যাঁ, কিছু আইনজীবী এমনটিই মনে করেন। যদি ট্রাম্প ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন, তাহলে যে প্রেসিডেন্টের অধীনে তিনি নির্বাচিত হচ্ছেন, তাকে পদত্যাগ করতে হবে না— কয়েক মাস আগে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেছিল পেনসিলভানিয়া ভিত্তিক আইন সংস্থা কর্নারস্টোন ল। যদি প্রেসিডেন্ট অস্থায়ীভাবে অক্ষম হন, তবে ট্রাম্প ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী ‘অ্যাক্টিং (ভারপ্রাপ্ত) প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন।

এই যুক্তি আবারও ২২তম সংশোধনীর দিকেই নির্দেশ করে, যেখানে একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না এমনটিই বলা আছে। তবে অন্য কোনো উপায়ে প্রেসিডেন্ট হতে বাধা নেই। তবে কর্নারস্টোনের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এই ব্যাখ্যা আইনি দিক থেকে পরীক্ষিত হয়নি এবং এটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।

আরও কিছু বিকল্প ধারণাও সামনে এসেছে- যেমন ট্রাম্পকে ক্যাবিনেট সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রেসিডেন্টের উত্তরাধিকারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, কিন্তু এর জন্য সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।

তিনি ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট না হলেও ‘শ্যাডো প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে কাজ করতে পারেন, যেখানে তিনি প্রেসিডেন্টের মতো বিশাল রাজনৈতিক প্রভাব রাখবেন, কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক পদ পাবেন না। তাতেও আদালত সম্ভবত ২২তম সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্যটি বিবেচনা করবেন।

ব্রুস ফেইনের ভাষ্য, ট্রাম্পের বক্তব্য এবং উদ্দেশ্যকে কেবল মজা হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, যতটা জানি, ট্রাম্প সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে নষ্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

‘শেষ কথা হলো, আইন শুধুমাত্র জনগণের তা মেনে চলার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল,’ বলেন তিনি। এটি এমন বিষয়, যার জন্য মানুষ লড়াই করতে, এমনকি মরতে পর্যন্ত রাজি।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS