News Headline :
ভারতে মুসলিম ফেরিওয়ালাকে যেভাবে পিটিয়ে মারা হলো

ভারতে মুসলিম ফেরিওয়ালাকে যেভাবে পিটিয়ে মারা হলো

ভারতে প্রায়ই সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে রেহাই পান না দলিত বা নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও। বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের গরু মাংস বিক্রি বা খাওয়ার সন্দেহে হত্যার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আসে।

এর সবশেষ শিকার হলেন বিহারের নালন্দা জেলার গগন দিওয়ান গ্রামের মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন।

৪০ বছর বয়সী আতাহারকে ৫ ডিসেম্বর রাতে নাওয়াদা জেলার রোহ অঞ্চলের ভট্টা গ্রামে নৃশংসভাবে মারা হয়। বিহার শরীফ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।

সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে আতাহার হুসেইনের স্ত্রী শবনম পারভিন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমাকে স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। যখনই বললো যে নাম মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন, সঙ্গে সঙ্গেই আট-দশজন মারতে শুরু করল।আমার স্বামীকে মেরে ফেলল। আমি বিধবা হয়ে গেলাম, সন্তানরা অনাথ হয়ে গেল! এখন ওরা কাকে বাবা বলে ডাকবে?’

এ বিষয়ে আতাহার হুসেইনের পরিবার থানায় মামলা করেছে। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, চুরির ভুয়া অভিযোগে বেশ কয়েকজন তাকে নৃশংসভাবে মারধর করে। জানা গেছে, কাপড় খুলে তার ধর্মীয় পরিচয় জেনে বেধড়ক পেটানো হয় আতাহারকে।

আবার যাদের বিরুদ্ধে তাকে গণপিটুনি দেওয়ার অভিযোগ, তারা পাল্টা অভিযোগ করে, আতাহার চুরির উদ্দেশে রাতে তাদের ঘরে ঢুকেছিলেন এবং চুরি করতে তাকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল।

আতাহারকে গণপিটুনি দেওয়া এবং তার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পরিবার বলছে, তিনি গত প্রায় ২০ বছর ধরে রোহ এবং তার আশপাশের এলাকায় সাইকেলে চেপে কাপড় বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তার শ্বশুরবাড়িও ওই অঞ্চলেরই মরুই গ্রামে।

নওয়াদা সদর ডেপুটি পুলিশ সুপার হুলাস কুমার বলেন, ৫ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ খবর পায়, একজনকে চুরি করতে ধরে রেখেছে মানুষ।পরের দিন দুটো মামলা হয়। একটিতে আতাহার হুসেইনকে চুরির ঘটনায় মূল অভিযুক্ত করা হয়, আর অন্যটিতে তার স্ত্রী অভিযোগ করেন যে তাকে মারধর করা হয়েছে।।

তবে হুলাস কুমার স্বীকার করেন, তারা তদন্ত করে আতাহার হুসেইনের কোনো অপরাধমূলক কাজের রেকর্ড খুঁজে পাননি।

আতাহার হুসেইনের ভাই মুহাম্মদ চাঁদ বলেন, ‘৬ ডিসেম্বর আমরা যখন এফআইআর দায়ের করি তখনও তো আমার ভাই অজ্ঞান ছিল। আমাদের কাছে শুধু চুরির ভুয়া অভিযোগে মারধর করারই খবর ছিল। এরপরে যখন ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে আমাদের বলে যে কীভাবে তার কাপড় খুলিয়ে ধর্মীয় পরিচয় জানা হয়েছে।’

মুহাম্মদ চাঁদ আরও বলেন, ‘ঘটনাটির পর আমরা সবাই ভয়ে আছি। আমাদের গ্রামের কোনো মুসলমান পুরুষ ফেরি করতে বা পশু বা অন্যান্য ব্যাপারীরা গ্রামের বাইরে বেরোচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর আগে তার ভাই জানিয়েছিলেন যে ৫ ডিসেম্বর রাতে কাপড় ফেরি করে যখন ডুমরি গ্রাম থেকে নিজের বাড়ির দিকে ফিরছিলেন তখন তার সাইকেলের চাকা পাঙচার হয়ে যায়।’

‘অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল তখন। ভট্টা গ্রামের পাশে একটা মোড়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন কয়েকজন মানুষ – তাদের কাছেই ভাই জানতে চায় যে পাঙচার সারানোর দোকান কোথায় আছে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকা ওই ব্যক্তিরা ভাইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করে। যেই নিজের নাম মুহাম্মদ আতাহার হুসেইন বলে ভাই, তখনই হামলা করে ওই ব্যক্তিরা।’

মুহাম্মদ চাঁদ বলেন, ‘সেখানে আট-দশজন ছিল। জোর করে সাইকেল থেকে ভাইকে নামিয়ে তার সব টাকা-পয়সা লুট করে নেয় আর ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করার পরে হাত-পা বেঁধে টানতে টানতে তাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় ওরা। সেখানেই বেধরক মারধর করে আধমরা করে ফেলে দেয় ওরা।’

তিনি জানান, হামলাকারীরা ভেবেছিল যে তার ভাই মারা গেছে। তারপরেই পুলিশকে ফোন করে চুরির কাহিনিটা সাজায় ওরা।

পুলিশ এসে আতাহার হুসেইনকে নওয়াদা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করায়।

আতাহার হুসেইনের স্ত্রী শবনম বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, দেখি তাকে ভীষণ মেরেছে। আমার গলার আওয়াজ পেয়েই তার জ্ঞান ফেরে – ধীরে ধীরে চোখ খোলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ‘ভীষণ ব্যথা। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করো। আমার চিকিৎসা করাও’। ওখানে যে পুলিশ ছিল তাদের আমি অনেক বলেছিলাম, তবুও ওরা আমার স্বামীকে নিয়ে যেতে দেয় নি, বলেছিল ওখানেই চিকিৎসা হবে, কোথাও যেতে দেওয়া হবে না।’

তিন দিন পরে আতাহার হুসেইনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। পরিবার অনুরোধ করেছিল কোনো বেসরকারি হাসপাতালে তাকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হোক। পরে পাওয়াপুরী সদর হাসপাতালে পাঠানো হয় আতাহারকে। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে একদিন পরে পরিবারের সদস্যরা আহত আতাহারকে নিয়ে বিহার শরীফের দিকে রওনা হন। পথেই তার মৃত্যু হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা মুহাম্মদ আসগার বলছিলেন, ‘আতাহার প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে সাইকেলে চেপে কাপড় ফেরি করেন। নারী ও শিশুদের জামা কাপড় বিক্রি করতেন তিনি। তার শ্বশুরবাড়িও রোহ এলাকায়, নিয়মিতই আসতেন। গ্রামের নারীরা তো সবাই চিনত আতাহারকে।’

(সূত্র: বিবিসি বাংলা)

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS