ওসমান হাদির কবর দেখতে রাতেও সাধারণ মানুষের ভিড়

ওসমান হাদির কবর দেখতে রাতেও সাধারণ মানুষের ভিড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে শায়িত ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শহীদ শরিফ ওসমান হাদির কবর দেখতে রাতেও সাধারণ মানুষের ভিড়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত সাধারণ মানুষ এই বিপ্লবী নেতার কবর দেখতে ভিড় করছেন শাহবাগে। একই সঙ্গে তারা হাদির হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত জনসম্মুখে বিচারের দাবি জানান।

শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন সমাধিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের দক্ষিণ পাশে হাদিকে দাফন করা হয়।

রাতে সমাধিস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখনও দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ আসছে শহীদ শরিফ ওসমান হাদির কবর দেখতে। তারা এক নজরে এই বিপ্লবী নেতার কবর দেখে আল্লাহর দরবারে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। একই সঙ্গে সরকারের কাছে হাদির হত্যাকারীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানান।

বরিশাল থেকে হাদির কবর দেখতে আসা মো. মাহবুব আলম বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদের যে ছায়া সেটা থেকে বেড়িয়ে আসতে শহীদ ওসমান হাদির কণ্ঠ ছিল সবসময় সোচ্চার।তাই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারণ তারা জানে হাদি একমাত্র তাদের প্রতিপক্ষ। তাই তাকে সড়িয়ে দেওয়া হলো। আমরা আজকে কাঁদবো না, তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো।

একই সঙ্গে সরকারকে দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাতে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর কেউ ঘটাতে সাহস না পায়।

চাঁদপুর থেকে আসা মো. মমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওসমান হাদি না ফেরার দেশে চলে গেছে। কিন্তু প্রশাসন বা সরকার এখন পর্যন্ত হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। হাদির খুনিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে।সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি যে তার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। কারণ খুনি হাসিনা দেশে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে একটি অরাজকতা তৈরির করতে চাচ্ছে। এসব বিষয়ে সবার সজাগ থাকতে হবে।’

তিনি বলেন, জুলাইয়ের বাংলাদেশ থেকে কোনো দেশের বা ভারতের দালালি করা যাবে না। আমরা আর কোনো ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হতে দেবো না। নয় দিন হলো এখন পর্যন্ত কাউকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি সরকার। তাই বলবো যদি লজ্জা, আত্মসম্মান থেকে থাকে তাহলে পদত্যাগ করে জাতিকে মুক্তি দিন। এরপর আমরা একটা বিপ্লবী সরকার গঠন করে যারা জন মানুষের কথা ও অধিকার রক্ষা করবে, মানুষের জান মালের নিরাপত্তা দিতে পারবে। একই সঙ্গে হাদির হত্যাকারীর মূল অপরাধীকে না পেলে তার পরিবারের লোকদের অপরাধী হিসেবে ফাঁসির সাজা দেওয়া উচিত। যাতে পরবর্তীতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেন কেউ না করে।

এদিকে আজ শনিবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় শহীদ শরিফ ওসমান হাদির জানাজার পর শাহবাগে এক সমাবেশে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) খোদা বখস চৌধুরীকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া (আলটিমেটাম) হয়। এ সময়ের মধ্যে জবাব দিতে না পারলে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছে ইনকিলাব মঞ্চ।

 ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের দুটি দাবি তুলে ধরে বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী) ও সহকারী উপদেষ্টাকে (খোদা বখস চৌধুরী) জনতার সামনে এসে বলতে হবে, গত এক সপ্তাহে তারা কতটুকু এগিয়েছেন। এর জবাব দিতে না পারলে তাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। সিভিল-মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা) মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করুন।

বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক এখানে থাকব। কিন্তু আপনাদের একটু রেস্ট (বিশ্রাম) দিতে চাই। আপনারা আজকের জন্য বাসায় যান। আগামীকাল বিকেল সোয়া পাঁচটার মধ্যে যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না আসে, আমরা আবার এখানে আসব। অনেক ছাড় দিয়েছি, আর ছাড় দেব না।

প্রসঙ্গত, ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা ওসমান হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদালয়ে শিক্ষকতা করতেন। গত বছর জুলাই আন্দোলন শুরু হলে তাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন তিনি। অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টেই ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করেন তিনি। সাংস্কৃতিক এই প্ল্যাটফর্ম তাদের লক্ষ্য ঠিক করে– ‘সব আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ।’ এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়েই একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন হাদি।

 গত ১২ ডিসেম্বর ওসমান হাদি ঢাকার বিজয়নগরে দুর্বৃত্তের হামলায় আহত হন। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তিন দিন পর নেওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। তবে চিকিৎসকদের সব প্রয়াস ব্যর্থ করে গত ১৮ ডিসেম্বর ওসমান হাদির জীবনাবসান ঘটে। কফিনবন্দী হয়ে গতকাল শুক্রবার দেশে ফেরেন জুলাই আন্দোলনের এই সৈনিক। তার মরদেহ রাখা হয় শেরেবাংলা নগরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। সেখান থেকে আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়েছিল পাশের সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ফিরিয়ে এনে গোসল করানো হয়। এরপর বেলা ২টার আগে ওসমান হাদির মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়।

ওসমান হাদির জন্য শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। শোকের আবহের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের মিছিল সকাল থেকে ছুটতে থাকে সংসদ ভবন পানে। সেই মিছিলে উচ্চারিত হচ্ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। গোটা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউজুড়ে কাতারবদ্ধ হয়ে জানাজায় অংশ নেন লাখো মানুষ। জানাজা শেষে ওসমান হাদির কফিন নিয়ে মিছিল রওয়ানা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে। বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ এলাকায় পৌঁছায় কফিন। জাতীয় কবির সমাধির পাশে ওসমান হাদির কবরের বন্দোবস্ত আগেই করে রাখা হয়েছিল। সব প্রক্রিয়া শেষে এক ঘণ্টার মধ্যেই সেই কবরে শায়িত করা হয় ওসমান হাদিকে।

প্রসঙ্গত, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনে (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর থানা) স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরেই মাঠে তৎপর ছিলেন হাদি। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে আক্রান্ত হন তিনি। এ হামলার জন্য পতিত আওয়ামী লীগকে দায়ী করছেন তার সমর্থকেরা। গুলিবর্ষণকারী হিসেবে পুলিশ যাকে চিহ্নিত করেছে, সেই ফয়সাল করিম মাসুদ নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতা। হাদি হত্যা মামলায় পুলিশ ১৪ জনকে আটক করলেও ফয়সাল করিম এখনো ধরা পড়েননি।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS