অনেকেরই এটা একটা পরিচিত অভিযোগ। হাত–পা ঝিঁঝিঁ করে, কখনো জ্বালাপোড়া করে। তবে এটা কোনো রোগ নয়, বরং কিছু রোগের লক্ষণ। সাধারণত প্রান্তীয় স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনুভূতির নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। রোগের শুরুতে পা ঝিনঝিন বা জ্বালাপোড়া করে, ধীরে ধীরে অনুভূতিশক্তি কমে যায়। কেউ কেউ বলেন বৈদ্যুতিক শকের মতো লাগে বা পিনের খোঁচা কিংবা পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে বলে মনে হয়। অনেক সময় সামান্য স্পর্শেই ভিন্ন ধরনের অনুভূতি হয়। প্রান্তীয় স্নায়ু যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এরা মস্তিষ্কে বারবার ব্যথার বার্তা পাঠাতে থাকে। এর ফলে কোনো ক্ষত না থাকলেও জ্বালা বা ব্যথা বোধ হতে থাকে। পায়ের ওপর কেউ কেউ কাঁথা-কাপড় পর্যন্ত রাখতে পারেন না। রাতে ঘুমানোর সময় পা উদাম রাখতে হয়। এসব কারণে ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এতে সমস্যা আরও জটিল হয়। হাতের চেয়ে পায়ে সমস্যা হয় বেশি। এ ধরনের অনুভূতিগুলো পায়ের তালু থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকে। সমস্যা বেশি হলে অনেক সময় পায়ের অনুভূতি কমে যায়, পা থেকে স্যান্ডেল খুলে পড়ে গেলে বা আঘাত পেলেও রোগী টের পান না। এ রকম নীরব আঘাত থেকে ক্ষত তৈরি হয় এবং পরে গ্যাংগ্রিন হতে পারে।
কারণ কী
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা প্রান্তীয় স্নায়ুর সমস্যা অনেক কারণেই হতে পারে। অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে রক্তে উচ্চমাত্রার শর্করা থাকার কারণে এই জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারেন ৬০-৭০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী। এ ছাড়া ভিটামিন বি–র উপাদান যেমন থায়ামিন (বি-১), পাইরোডোক্সিন (বি-৬), সায়ানোকোবালামিন (বি-১২), নিকোটানিক অ্যাসিড ও রিবোফ্লাভিনের অভাবে পা জ্বালা এবং ব্যথা করে।
বিপাকীয় ও হরমোনের সমস্যা যেমন হাইপোথাইরয়েডিজম, বাতব্যথা যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ক্যানসার, এইডসের কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
কিডনি ফেইলিউর, হেমোডায়ালাইসিসের রোগী এবং যকৃতের সমস্যায়ও এই সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় কেমোথেরাপি বা বিশেষ কিছু ওষুধ সেবনে যেমন যক্ষার ওষুধ, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধসহ আরও কিছু ওষুধ সেবনে পা জ্বালাপোড়া হতে পারে।
অতিরিক্ত মদ্যপান বা ধূমপান, ভারী ধাতুদূষণসহ আরও কিছু কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্নায়ু। অ্যালার্জি হয়, এমন কাপড় ও মোজা ব্যবহার করলে এবং ত্রুটিপূর্ণ জুতা পরলেও এই সমস্যা হতে পারে।
পায়ের স্নায়ু আহত, অবরুদ্ধ (এনট্রাপমেন্ট) বা সংকুচিত (কমপ্রেশন) হলেও এই সমস্যা হতে পারে।
এ ছাড়া মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির বা বংশানুক্রমিক অসংগত স্নায়ুপদ্ধতির কারণেও অনেক সময় পায়ে জ্বালাপোড়া হয়।
নারীদের মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইস্ট্রজেনের অভাবেও জ্বালাপোড়া হতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি রোগ নির্ণয়ে রোগীর পূর্ব ইতিহাস জানার পাশাপাশি ভালো করে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোন ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নার্ভ কনডাকশন পরীক্ষা করা যেতে পারে।
কী করবেন
রোগ প্রতিরোধে দরকার হলে বিশেষ কিছু ভিটামিন খেতে হবে, বি–১২–এর অভাবজনিত রোগে ভিটামিন ইনজেকশন পুশ করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
মদ্যপান ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
স্নায়ু জখম, অবরুদ্ধ বা সংকুচিত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সঠিক মাপের খোলা ও আরামদায়ক জুতা এবং মোজা পরতে হবে। পায়ের আর্চ সাপোর্ট, ইনসোল ও হিল প্যাড ব্যবহারে উপসর্গ অনেকটাই কমবে।
পায়ের পেশির ব্যায়াম ও ঠান্ডা পানির (বরফ না) সেঁক নেওয়া যেতে পারে।
কোনো ওষুধ গ্রহণের কারণে রোগীর পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হচ্ছে কি না, লক্ষ করতে হবে।
হাত-পা ঝিনঝিন করার অনুভূতি অস্বস্তিকর হলেও সঠিক কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রদান করা গেলে তা নিরাময়যোগ্য। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল