প্রায় এক মাস আগে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবিসির এক শো-তে উপস্থিত হয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি সহজ-সাবলীল পরিবেশে হওয়ার কথা ছিল, যেখানে তিনি আমেরিকানদের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে পারতেন এবং মানুষ তাকে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ পেত।
কিন্তু পুরো আলাপচারিতা হঠাৎই অন্যদিকে মোড় নেয় যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের থেকে তিনি আলাদাভাবে কী কী করবেন। হ্যারিসের উত্তর ছিল, মনে আসছে না কিছুই।
এই এক বাক্যে তিনি যেন সবাইকে হতবাক করে দিলেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, তিনি হয়তো বাইডেন প্রশাসনের কাজের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করবেন বা তার নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। কিন্তু এর পরিবর্তে তিনি এমন এক সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন, যা তার নেতৃত্বের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলে।
এ প্রতিক্রিয়াটি তার উদ্দেশ্যকেই যেন আড়ালে ফেলে দেয়, আর আলাপচারিতার মূল উদ্দেশ্য—জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন— ম্লান হয়ে যায়।
হ্যারিসের এ উত্তরের প্রতিক্রিয়া এতই তীব্র হয়েছিল যে রিপাবলিকানরা সেটিকে ব্যবহার করে বারবার প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপন তৈরি করে। এই মন্তব্য যেন তার প্রচারাভিযানের দুর্বলতাগুলো আরও বেশি করে সামনে তুলে আনে।
রাজনৈতিকভাবে উল্টো হাওয়ার মুখে তার প্রচারণা শুরু থেকেই নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার চূড়ান্ত পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
নির্বাচনী এ দৌড়ে সবশেষ বুধবার বিকেলে তিনি পরাজয় স্বীকার করে নেন। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, হতাশ হবেন না।
হ্যারিস কোথায় ভুল করেছেন, তিনি আর কী কী করতে পারতেন, এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে হয়তো সময় লাগবে। এর মধ্যেই ডেমোক্রেটরা তার দিকে আঙুল তুলতে শুরু করবে এবং দলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করবে।
বুধবার সকালের দিকে হ্যারিসের নির্বাচনী প্রচার শিবিরের কর্মকর্তারা অনেকটাই নিশ্চুপ ছিলেন। তার সহযোগীদের অনেকে অশ্রুসিক্ত হয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা ছিল, হয়তো প্রতিযোগিতাটি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।
হ্যারিসের প্রচার শিবিরের ব্যবস্থাপক জেন ও’ম্যালে ডিলন বুধবার কর্মীদের উদ্দেশে এক ই-মেইল বার্তায় বলেন, হেরে যাওয়া বেশ কষ্টের। এটি বেশ কঠিন। এটি মেনে নিতে অনেকটা সময় লাগবে।
বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস এমন একটি পরিস্থিতিতে ছিলেন, যেখানে তিনি জনসমর্থনে ভাটা পড়া এক প্রেসিডেন্টের ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
প্রচারণার সময় অর্থনৈতিক উদ্বেগ ও হতাশার মধ্যে থাকা অনেক ভোটার পরিবর্তনের আশায় ছিলেন, কিন্তু হ্যারিস তাদের এই প্রত্যাশার সঙ্গে নিজেকে সঠিকভাবে সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হন।
বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং জনপ্রিয়তার ঘাটতি তাকে এমন এক অবস্থায় ফেলে, যেখানে নিজের স্বতন্ত্র পরিকল্পনা বা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরাটা কঠিন হয়ে যায়।
ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে নাস্তানাবুদ হয়ে প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে যান জো বাইডেন। নির্বাচনী দৌড়ে নামার টিকিট পেয়ে যান কমলা হ্যারিস। এ কারণে তিনি প্রাইমারি ভোটে যাচাইয়ের বাইরে থেকে যান। এ প্রাইমারি ভোটে সাধারণত প্রার্থীকে দলের ভোটারদের সমর্থন ও আস্থা অর্জন করতে হয়।
প্রাইমারি ভোট ছাড়াই এমনভাবে মনোনয়ন পাওয়া অনেকের কাছেই বিতর্কিত মনে হয়েছিল, এবং এতে তার নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়।
নেতৃত্বের নতুন প্রজন্মের আশ্বাস দিয়ে হ্যারিস তার ১০০ দিনের প্রচারণা শুরু করেন। নারীদের গর্ভপাতের অধিকার আইন নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে যান। তিনি ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও আবাসনের সামর্থ্যসহ অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে নানা অঙ্গীকার করে শ্রমজীবী ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা চালাতে থাকেন।
ভোটের আগের তিন মাসের মধ্যে হ্যারিস প্রারম্ভিক এক ধরনের গতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। এরপর হ্যারিসের প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে, যেখানে বিভিন্ন মিম এবং হাস্যকর পোস্ট ভাইরাল হয়।
টেইলর সুইফটসহ শীর্ষস্থানীয় সেলেব্রিটিদের অনেকে তার পক্ষে প্রচারণায় নামেন। নির্বাচনী তহবিলেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়। তবে এসব সাফল্য সত্ত্বেও হ্যারিস তার বাইডেন-বিরোধী মনোভাবকে নাড়াতে পারেননি যা বেশিরভাগ ভোটারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রেসিডেন্টের অনুমোদন রেটিং তার চার বছর মেয়াদে বরাবরই ৪০ শতাংশের নিচে ছিল, যা তার জনপ্রিয়তার মধ্যে গভীর চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে যখন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভুল পথে চলছে।
কিছু সহযোদ্ধা প্রশ্ন তোলেন যে, হ্যারিস কি বাইডেনের প্রতি অতিরিক্ত আস্থা রেখেছিলেন তার নিজস্ব প্রচারণায়। তবে, হ্যারিসের প্রাক্তন যোগাযোগ পরিচালক জামাল সিমন্স বিষয়টিকে একটি ‘ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তার দাবি, বাইডেন থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করলে এটি কেবল রিপাবলিকানদের জন্য নতুন একটি আক্রমণমূলক তাস হয়ে দাঁড়াত, যেখানে তাকে ‘অবিশ্বস্ত’ বলে চিহ্নিত করা হতো। এ পরিস্থিতিতে, হ্যারিসের জন্য আদর্শ ছিল বাইডেনের প্রতি আনুগত্য দেখানো, তবে তাতে কিছু সমালোচনাও অবশ্যম্ভাবী ছিল।
তিনি বলেন, যিনি আপনাকে বেছে নিয়েছেন, সেই প্রেসিডেন্ট থেকে আসলে আপনি দূরে যেতে পারবেন না।
হ্যারিস চেষ্টা করেছিলেন একটি সূক্ষ্ম সীমানা রাখতে, যেখানে তিনি প্রশাসনের কাজকর্মের কথা বলবেন, কিন্তু বাইডেনের প্রতি কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না। তিনি এমনভাবে তার প্রচারণা চালান, যাতে মনে হচ্ছিল বাইডেনের নীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান, তবে সরাসরি সেগুলোর প্রচার করতে চান না। এ কৌশল তাকে রাজনৈতিকভাবে কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল।
তবে, হ্যারিস তার প্রচারণায় দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেকে কেন উপযুক্ত বলে প্রমাণ করবেন এবং কীভাবে তিনি অর্থনৈতিক হতাশা ও অভিবাসন সংক্রান্ত ব্যাপক উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করবেন, সে বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন।
হ্যারিসের প্রচার শিবির আশা করেছিল, ২০২০ সালে বাইডেনের জয়ী হওয়ার পেছনে যে ভোটার ভিত্তি কাজ করেছিল, সেটিকে আবার পুনর্গঠিত করতে সক্ষম হবে। এর মধ্যে ছিল- মূল ডেমোক্রেটিক সমর্থক, আফ্রিকান-আমেরিকান, লাতিনো, তরুণ ও শহরতলির শিক্ষিত ভোটাররা। কিন্তু হ্যারিস এ গুরুত্বপূর্ণ ভোটার গোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রত্যাশিত সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হন।
ভারমন্টের স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ২০১৬ সালে ডেমোক্রেট দলের প্রাইমারিতে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে হেরে যান। পরে ২০২০ সালে তিনি হেরে যান জো বাইডেনের সঙ্গে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই, শ্রমজীবীরা পার্টি বর্জন করেছেন।
তিনি বলেন, প্রথমে ছিলেন শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবীরা, এখন লাতিনো ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমজীবীরাও। যতই ডেমোক্রেটিক নেতৃত্ব স্থিতাবস্থা রক্ষা করতে চেষ্টা করুক না কেন, আমেরিকান জনগণ ক্রমশই ক্ষুব্ধ এবং তারা পরিবর্তন চায়। এবং তারা সঠিক।
যতটা প্রত্যাশিত ছিল, ততটা সমর্থন পাননি হ্যারিস, বিশেষ করে শহরতলির রিপাবলিকান নারীদের কাছে। যদিও নারীরা সাধারণত ট্রাম্পের তুলনায় হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। তবে তা আশানুরূপ হয়নি। তিনি ৫৩ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ নারীদের ভোট হারান।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটরা আশা করেছিলেন যে, হ্যারিসের এ সংক্রান্ত প্রচারণা হয়তো তাকে জয় এনে দেবে। বাস্তবে এটি নির্বাচনী ফলে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
৫৪ শতাংশের মতো নারী ভোটার হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। যেখানে ২০২০ সালে ৫৭ শতাংশ ভোট পান জো বাইডেন। এক্সিট পোল উপাত্ত সূত্রে এমনটি জানা যায়।
হ্যারিস যখন নির্বাচনের টিকিট পেয়ে যান, তখন তিনি নির্বাচনী প্রতিযোগিতাটিকে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি গণভোট হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক প্রসিকিউটর তার আইনি অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার চেষ্টা করছিলেন।
তবে তার প্রাথমিক প্রচারণা বাইডেনের মূল যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়, যেখানে বলা হয়েছিল ট্রাম্পের শাসন গণতন্ত্রের জন্য প্রাণঘাতী হুমকি। এর বদলে হ্যারিস সামনে একটি ‘আনন্দময়’ বার্তা দিতে শুরু করেন, যা মূলত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কল্যাণ বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
শেষ মুহূর্তে, হ্যারিস একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে তিনি আবারও ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির ঝুঁকি তুলে ধরেন। তিনি ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে তকমা দেন এবং এমন রিপাবলিকানদের সঙ্গে প্রচারণা শুরু করেন, যারা তার ভাষণের কারণে ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
ট্রাম্পের আমলের হোয়াইট হাউস চিফ অব স্টাফ জন কেলি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ট্রাম্প অ্যাডলফ হিটলার সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। আর হ্যারিস তার সরকারি বাসভবনের বাইরে ট্রাম্পকে ‘অস্থির ও অপ্রত্যাশিত’ বলে বর্ণনা করেন।
মঙ্গলবার রাতে বর্ষীয়ান রিপাবলিকান জনমত জরিপকারী ফ্র্যাঙ্ক লান্টজ বলেন, কমলা হ্যারিস এ নির্বাচনে তখনই হেরে যান, যখন তিনি প্রায় একচেটিয়াভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আক্রমণ করার দিকে মনোনিবেশ করেন।
তিনি বলেন, ভোটাররা ইতোমধ্যেই ট্রাম্প সম্পর্কে সবকিছু জানেন। তারা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম ঘণ্টা, প্রথম দিন, প্রথম মাস এবং প্রথম বছরের পরিকল্পনা কেমন হবে, সেই সম্পর্কে আরও জানতে চেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, হ্যারিসের নিজস্ব পরিকল্পনার বিপরীতে ট্রাম্পের ওপর মনোনিবেশ করা তার প্রচারণার জন্য এক বিশাল ব্যর্থতা ছিল।
শেষ পর্যন্ত, হ্যারিসের প্রয়োজনীয় বিজয়ী সমর্থন গড়ে ওঠেনি, যা ট্রাম্পকে হারাতে তার জন্য সহায়ক হয়ে উঠতে পারত। ডেমোক্রেটদের প্রতি ভোটারদের ব্যাপক প্রত্যাখ্যান এটি দেখায় যে, পার্টির সমস্যা শুধু এক অপ্রিয় প্রেসিডেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের সংকট আরও গভীর, আরও ব্যাপক।