কম হলেও ১৫ জন ‘যাব যাব’ করছে। যেকোনো যাত্রার শুরুতে এমনটাই হয়। কিন্তু যাত্রার শুরুটা একসঙ্গে করলেও শেষ গন্তব্যে সবাই পৌঁছাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকল আটজন।
আমার বন্ধু ইশতিয়াক বিএমএ লং কোর্স শেষ করে ঢাকায় ফিরে ফোন করল, ‘বান্ধবী, মুক্তি পাইসি। এখন কোনো কথা শুনব না। ঘুরতে যাইতে হবে। তাড়াতাড়ি ভেবে ফেল কোথায় যাবি।’ ভাবলাম এই ঠাডা পড়া গরমে আবার ঘুরতে যায় নাকি মানুষ! ভাবতে ভাবতেই দেখি সাড়ে সেয়ানা ইশতিয়াক হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপও খুলে ফেলেছে। গ্রুপের মধ্যে মানুষের অভাব নেই। সবাই যেতে চায় শ্রীমঙ্গল। কম হলেও ১৫ জন ‘যাব যাব’ করছে। যেকোনো যাত্রার শুরুতে এমনটাই হয়। কিন্তু যাত্রার শুরুটা একসঙ্গে করলেও শেষ গন্তব্যে সবাই পৌঁছাতে পারে না। পুরো ব্যাপারটির অদ্ভুত সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘দারুচিনি দ্বীপ’ বইয়ের সিকুয়েল ‘রুপালী দ্বীপ’-এ। শুভ্রদের মতো আমাদের অনেকে যাত্রাপথে নেমে না গেলেও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে অনেকেই বাদ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকল আটজন। ছয়জন মেয়ে, দুজন ছেলে। শুনে বাপজান বলল, ‘তোমরা মেয়েরা দয়া করে দুজনকে নিয়ে যাচ্ছ নাকি!’
যাঁরা ট্রেনে ভ্রমণ করতে চান, বিশেষ করে সিলেটের দিকে, তাঁদের উদ্দেশে বলব, কম করে হলেও সাত দিন আগে টিকিট কাটবেন। অনলাইনে টিকিট না পাওয়ার আতঙ্কে ভ্রমণের জন্য ঠিক করা তারিখের ছয় দিন আগে বন্ধু অপিকে রাত ১০টায় স্টেশনে দৌড়াতে হয়েছিল। সেদিনও সার্ভারে সমস্যার কারণে টিকিট না পেয়ে আবার পরদিন সকালে গিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকিট কাটতে পেরেছিল। দুই দিনের যাত্রা। শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় যাওয়া আর ফেরা শনিবার রাত দুইটার ট্রেনে। থাকার জন্য ফেসবুক রিভিউজ ঘেঁটেঘুঁটে ঠিক করা হলো, শান্তিবাড়ি ইকো রিসোর্ট।
যাত্রার দিন বিমানবন্দর স্টেশনে গাটরিবোঁচকা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠে পড়লাম আমরা অনভ্যস্ত সাতজন। উৎস আগেই কমলাপুর থেকে উঠেছিল। ট্রেনে উঠে দেখি আমাদের সিটগুলো রক্ষায় সে ভীষণ তৎপর। কাউকেই বসতে দিচ্ছে না। চেয়ারবগির একেবারে মাঝের টেবিলওয়ালা সিট। আটজন মুখোমুখি বসে পড়লাম। ভ্রমণে গেলে নাকি মানুষের লুকানো অনেক স্বভাব বের হয়ে আসে। আমার বন্ধুদের ক্ষেত্রেও তা–ই দেখলাম। যেমন আরিত্রী এই শক্ত সিটে বসেও ঘাড় এলিয়ে ঘুমিয়ে গেল এবং যাত্রার পুরোটা সময় সে ঘুমিয়েই পার করল। লাবণ্য মাস্ক পরে চুল বেঁধে নিজেকে বাতাস থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল, ফুল বাইরের প্রকৃতির ছবি তুলতে শুরু করল আর অতি উৎসাহী আগ্নিলা বারবার বলতে লাগল, ‘দোস্ত, আমরা যাচ্ছি, আমরা যাচ্ছি!’ আড্ডা দিতে দিতে জানলাম সম্প্রতি হৃদয় ভেঙেছে ইশতিয়াকের। ঘোষণা করল জীবনেও আর বিয়ে করবে না। উৎস যেন এটার অপেক্ষায়ই ছিল। ওর একটা স্বভাব হচ্ছে কিছু হলেই বাজি ধরা। মুখে মুখে না, একেবারে লিখিত দলিলওয়ালা বাজি। ওপর থেকে ব্যাগ নামিয়ে কাগজ-কলম বের করে লিখতে শুরু করল, ‘ইশতিয়াক যদি আগামী ১৫ বছরে বিয়ে করে তাহলে সে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দেবে।’ সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করলাম আমি, আগ্নিলা ও অপি। বাকিরা ছিল ঘুমে।
১১টায় পৌঁছে গেলাম শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। গোলাপি রঙের স্টেশন থেকে বের হয়ে লাল রঙের জিপে করে চা–বাগান দেখতে দেখতে চলে গেলাম রিসোর্টে। আনারস খেতে দিয়ে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা বলল, রুম দেওয়ার সময় বেলা ১টা। তার ওপর ঝড়ের কারণে সেখানে বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই এমনকি ফোনের নেটওয়ার্কও নেই। একে তো ক্লান্ত, তার ওপর এই অবস্থায় কী করা যায়, হাত–মুখ কীভাবে ধুবো, বাসায় যোগাযোগ কীভাবে করব, ভাবতে ভাবতেই আকাশ কালো করে মেঘ জমা হলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড…তারপরই নামল ঝুমবৃষ্টি। আমরা যে যেভাবে ছিলাম, সবাই নেমে গেলাম ভিজতে। দল বেঁধে সামনে গিয়ে দেখি পুকুর। কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিজলাম। তারপর নিজেরাই রিসোর্টের কুয়া থেকে পানি তুলে গোসল শেষ করলাম।
দুপুরের খাবার খেতে গেলাম লন্ডন রেস্তোরাঁয়। ভাতের সঙ্গে সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস, মুরগি, ডাল, আর কয়েক পদের ভর্তা দিয়ে খেয়ে শহরে ঘুরেটুরে ফিরে এলাম রিসোর্টে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে কিন্তু বিদ্যুতের দেখা নেই। সবাই আঁচ করতে পারছিলাম রাতটা আজকে অন্ধকারেই কাটবে। সেটাও মানা যায় কিন্তু বাথরুমে পানি না থাকা যে মহাযন্ত্রণা। বিষয়টি রিসোর্টের রিসেপশনে জানালে তারা কুয়া থেকে পানি তুলে বালতিতে করে দিয়ে গেল। সেটা দিয়েই চালাতে হবে আজকের রাত। এই দেখে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত দিনে কম করেও ২০ বার হাত ধোয়া উৎস; মুখ গোমড়া করে বসে রইল।
রাত ৯টায় খাওয়ার ডাক পড়ল। টেবিলে টেবিলে মোম জ্বালিয়ে পুরো ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থা। মাঝখানে রাখা গোল টেবিল থেকে আমরা যে যার মতো খাবার নিয়ে নিলাম। মুরগির বারবিকিউ, পরোটা, সবজি, সালাদ আর হালকা করে পোড়ানো আনারস। বারবার আনারস খাওয়ানোর কারণ জানতে চাইলে ম্যানেজার রহস্য ভেদ করল। জানাল, তাদের নিজস্ব আনারসখেত আছে। বললাম, ‘আরও কিছু অন্য ফল গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেন; এক আনারস কত খাওয়া যায়?’ আমাদের সঙ্গেই ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে আরও কয়েকটি গ্রুপ খেতে বসেছিল। একজন বিদেশিনীকেও দেখলাম। খেতে খেতেই বিদ্যুৎ চলে এল। ফুঁ দিয়ে মোম নিভিয়ে দিতেই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দলটির একজন একটি মাইক নিয়ে একের পর এক গান গাইতে শুরু করলেন। সবই পুরোনো বাংলা ছবির গান, কয়েকটি হিন্দি গানও শোনালেন। লেবু–চা খেতে খেতে গান শুনে রুমে ফিরে এলাম আমরা।
ছয়জন মেয়ের জন্য নিচে বাথরুম আর ওপরে থাকার ঘরসহ একটি দোতলা বাঁশ-কাঠের কটেজ এবং অপি, ইশতিয়াকের জন্য শণ-কাঠের মাচার ওপর ছোট্ট ঘর।
ঘরের ভেতর আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ বিকট শব্দে কী জানি ডেকে উঠল। ভয়ে যে দৌড় দিয়ে বেরিয়ে যাব, সে উপায়ও নেই। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ফুল বলল, ‘এটা তক্ষকের ডাক। জন্তুটা তিনবারের একবারও বেশি ডাকে না, কী অদ্ভুত!’ অদ্ভুত কি না জানি না কিন্তু বিদঘুটে সেই ডাক আর জীবনে কোনো দিন শুনতে চাই না। তক্ষক ছাড়াও বিশাল বিশাল কয়েকটি পোকার উপদ্রব সহ্য করলাম। সেগুলো চেলা, বিছা, না কী জিনিস, এখনো জানি না। যেমন তাদের বাহারি উদ্ভট রং, তেমনই ভয়ংকর দেখতে! প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির তোড়ে রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। কাঠের ঘরে আঁচড় কাটছিল বড় বড় গাছ। শোঁ শোঁ আওয়াজ আর জানালায় ঠোকাঠুকির কারণ বুঝতে ফুল একবার উঠে গিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল। আমি ঘুমের ঘোরেই বললাম, ‘বাইরে ভূত, ঘুমাতে আয়।’
সকালে উঠে রিসোর্টের খাওয়ার হলে খিচুড়ি, ডিমের ঝোল, ডিমভাজি, সবজি, পরোটা, আর সালাদ দিয়ে নাশতা সারলাম। স্টেশন থেকে যে জিপওয়ালা ভাই আমাদের রিসোর্টে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাকেই আমরা ঠিক করে নিলাম শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখার জন্য। উনি ১১টায় গাড়ি নিয়ে চলে এলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। জায়গা ঠিক হলো, হরিণছড়া আর লাউয়াছড়া। জিপে করে বাতাসে ভেসে ভেসে আধঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম হরিণছড়ার শেষ মাথায়। জায়গাটির নাম নিসর্গ পল্লী। সিঁড়ির ওপর একেবারে ঝাঁ–চকচকে নতুন একটি ক্যাথলিক গির্জা। নাম, কুইন অব হলি রোজারি চার্চ। পাহাড়ের ওপর উঠে যাওয়া সিঁড়ির পাশে স্তরে স্তরে ফলকের ওপর খোদাই করা হয়েছে যিশুখ্রিষ্টের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোকে। চূড়ায় পৌঁছে দেখলাম যিশুর অন্তিম মুহূর্তের দৃশ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জায়গাটিতে আছে মাদার মেরির প্রতীকী সমাধিক্ষেত্র। অন্য কয়েকটি দলও সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাদের দেখলাম তারকাঁটার বেড়া টপকে কোথায় জানি যাচ্ছে। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে আমরা ছয়জন লক্ষ্মীটির মতো নিচে নেমে এলাম। ফুল আর উৎস ওপরেই রয়ে গেল।
নিচে নেমে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, দুজন দেখি চিৎকার করতে করতে লাফাতে লাফাতে নেমে আসছে অন্য একটি রাস্তা দিয়ে। ফুল বলল, ‘তোরা তাড়াতাড়ি ওপরে চল! দয়া কর! প্লিজ, প্লিজ!’ উৎস বলল, ‘না গেলে বুঝবি না, চল সবাই।’ একবার পাহাড় বেয়ে উঠে নেমে আবার ওঠা বিরাট সমস্যা। আমি সাফ বলে দিলাম, যাব না। বলেই হাঁটা দিলাম জিপের দিকে। ফুলও নাছোড়বান্দা। ওই পাহাড়ের ওপর আমাকে সে নিয়েই যাবে। জড়িয়ে ধরে, গালে চুমু খেয়ে, ঘ্যান ঘ্যান করে মাথা খেয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি করাল। আবার সবাই উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের ওপর খাসিয়াদের বাড়িঘর পেরিয়ে গোমড়া মুখে চূড়ায় উঠে আমার চক্ষু চড়কগাছ। সবুজে ভেসে যাওয়া প্রান্তরে মিলেছে ঘন কালো আকাশ। নিচে নেমে গেছে বিস্তৃত চা–বাগান। তীব্র বাতাসে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। যেকোনো সময় নামবে বৃষ্টি। হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে সবাই একটা বিশাল শেওড়াগাছ আবিষ্কার করে ফেললাম। গাছটির নিচে পড়ে আছে বেশ কয়েকটি মোম, মাটির পাত্র এবং তেলজাতীয় কিছু। বিষয়টি অতিপ্রাকৃত, তাতে সন্দেহ নেই। সবারই একটু গা ছমছম করতে লাগল। আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে গাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
জিপে উঠতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। গান শুনতে শুনতে চা–বাগানের মধ্যে নেমে গেলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। চা–বাগানের প্রহরীরা আমাদের দেখে তেড়ে এলেন। এত নিষেধের মধ্যেও আমরা বেশ কয়েকটি ছবি তুলে ফেললাম।
দুপুরের খাবার রাজু হোটেলে খাওয়ার পর লাউয়াছড়া বনের দিকে রওনা দিলাম। বনের ভেতর পাহাড়ের ওপর খাসিয়াপুঞ্জি। টিকিট কেটে একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বৃষ্টির কারণে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে পুরো পথ। সঙ্গে আছে জোঁক। গাইড বলল, ‘এক জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না।’ হাঁটতে হাঁটতে পানির সামনে চলে এলাম। এবার জুতা হাতে নিয়ে পার হতে হবে। সবার আগে গেল উৎস। আর ওপারে গিয়েই চোরাবালির মধ্যে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল। ওকে টেনে তুলে আবার হাঁটা শুরু। আধঘণ্টা হেঁটে পুঞ্জিতে পৌঁছে একটা কথাই মনে হলো, আমাদের সাধারণ দৈনিক জীবনযাপনের মাঝে যদি পর্যটকেরা হানা দেয়, চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতো করে আমাদের দেখে, তাহলে কেমন লাগবে? কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। তাই খুব দ্রুত নেমে এলাম আমরা। ফিরতি পথে কেমন যেন চুপচাপ হয়েছিল সবাই। কী ভাবছিলাম সবাই কে জানে।
রাতের খাবারের ব্যবস্থা রিসোর্টেই করা হলো। রাত ১টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে স্টেশনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। এই গভীর রাতে খুব বেশি যাত্রী নেই স্টেশনে। বেশ থমথমে পরিবেশ। প্যাঁচাগুলোও মনে হয় ঘুমাচ্ছে। শুধু ঝিঁঝিরাই অক্লান্ত ডেকে চলেছে। কেন জানি না কিন্তু এই ডাক রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎই ছেদ পড়ল নিস্তব্ধতায়। বিকট হুইসেল! কারও মুখে কথা নেই। কফি হাতে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বুঝলাম ব্যস্ততায় ফেরার সময় হয়েছে।