গভীর সংকটে অর্থনীতি

গভীর সংকটে অর্থনীতি

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, স্থবির মজুরি, কর্মসংস্থানের সংকট ও ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ বিপর্যয়ে দেশের অর্থনীতি এখন গভীর সংকটে। সরকারি পরিসংখ্যানে কিছু উন্নতির ইঙ্গিত মিললেও বাস্তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের লাখ লাখ পরিবার প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াইয়ে পড়েছে। আয়ের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে, জীবনযাত্রার ব্যয় সামাল দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

চাল, ভোজ্য তেল, শাকসবজি, পরিবহন ব্যয়, বাড়ি ভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ পারিবারিক আয়ের বড় অংশ গ্রাস করছে।

বিশেষ করে মজুরিভিত্তিক শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।

সরকারি হিসাবে ২০২৫ সালের নভেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে, যা ২০২৪ সালের নভেম্বরের ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে কম। তবে একই সময়ে মজুরি প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে ৮ দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে কাগজে-কলমে মূল্যস্ফীতি কমলেও সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে আরও কমেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া নাজুক অবস্থা থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। এর ফলে বৈদেশিক খাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৮৮ কোটি ডলার মার্কিন ডলারে, যা ২০২৪ সালের একই সময়ে ছিল ১৯৯৫ কোটি ডলার।

একই সঙ্গে রপ্তানি, আমদানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। তবে নিম্ন প্রবৃদ্ধি, দুর্বল বিনিয়োগ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

কর্মসংস্থানের চিত্র ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি সৃষ্টি ধীরগতির, আর অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্পমেয়াদি কাজ বাড়ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ী নিয়োগ এড়িয়ে চলায় আংশিক বেকারত্ব বেড়েছে।

বিশেষ করে ১৫-২৯ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে। শ্রমবাজারে প্রবেশ করা তরুণদের জন্য স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ চাকরি পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে, যা সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

অর্থনীতির আরেকটি বড় দুর্বলতা বিনিয়োগ খাতে। ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেমে এসেছে রেকর্ড সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৩ শতাংশে। উচ্চ ব্যবসায়িক ব্যয়, ডলারসংকট ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন উদ্যোগের বদলে টিকে থাকার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) জিডিপির ১ শতাংশেরও নিচে সীমাবদ্ধ রয়েছে, যা অর্থনীতির বৈচিত্র্য ও মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়ার কথা কেউ ভাবছে বলে আমার জানা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কিংবা কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে সরকার কারও সঙ্গে আলোচনায়ও বসছে না। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া এখন অনেকটাই দুর্লভ বিষয়। এত উচ্চ সুদ আর ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে নতুন ব্যবসা করাও অনেক কঠিন। নতুন ব্যবসা না হওয়ায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমবে- এটাই স্বাভাবিক। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এখন ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪৪ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সরকার পরিবর্তনের আগে গত জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ দশমিক ১১ লাখ কোটি টাকা (১২ দশমিক ৫ শতাংশ)। হাতে গোনা ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ কমেনি। বরং ব্যাংকগুলো এই নীতির বাস্তবায়নে অনাগ্রহী এবং দায় এড়িয়ে চলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যাংকের আমানত ঝুঁকিতে পড়ছে এবং আস্থার সংকট গভীর হচ্ছে। ব্যাংক হিসাব তলবের কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ স্থগিত করেছেন। নতুন ব্যবসা ও সম্প্রসারণে অনীহার ফলে এলসি খোলা, কাঁচামাল আমদানি ও বেতন পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজেট ঘাটতি বেড়ে গেছে। আর্থিক স্থিতিশীলতায় ঝুঁকি রাজস্ব ক্ষতি বেসরকারি ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।

ডলারসংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, দুর্বল কর-ব্যবস্থা, ঋণের চাপ, রপ্তানি বৈচিত্র্যের অভাব, দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি বৈশ্বিক যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার প্রভাব অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলেছে। পরিসংখ্যানের কিছু উন্নতি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি ফেরেনি। মূল্যস্ফীতি, মজুরি স্থবিরতা, কর্মসংস্থান সংকট ও ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি এখনো গভীর সংকটেই রয়ে গেছে। টেকসই উত্তরণে জরুরি হয়ে উঠেছে শক্ত কাঠামোগত সংস্কার, সুশাসন এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে আস্থা ফিরিয়ে আনা।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই জিডিপির আনুপাতিক হারে একই পর্যায়ে অর্থাৎ ২২-২৩ শতাংশই রয়ে গেছে।

বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে সচেতন থাকলেও দৃশ্যমান তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিনিয়োগ স্থবিরতা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হবে না, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও হবে না। ফলে সরকারের যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটাও অর্জন হবে না। 

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS