চালের অন্যতম উৎপাদন এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলার সিংহভাগ চাল নাচোল ও গোমস্তাপুর উপজেলায় উৎপাদিত হয়।অথচ সিন্ডিকেটের কারণে এখানেই চালের বাজার এখন অস্থির।
স্থানীয় বাজারগুলোতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সব ধরনের আমন চালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৪ টাকা বেড়েছে। এরই মধ্যে তড়িঘড়ি করে দামের লাগাম ধরতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জেলায় অভ্যন্তরীণ আমন ধান ও চাল সংগ্রহ, বাজারমূল্য ও মজুত কার্যক্রম তদারকি বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চালানো হয়েছে অভিযানও।
শনিবার (২০ জানুয়ারি) বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন বলেছেন, যারা অবৈধভাবে ধান ও চাল মজুত করে রেখেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন থেকে এইসব মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হবে। এসময় তিনি যেকোনো মূল্যে চালের বাজার চলতি মাসের শুরুর দিকে যেমন ছিল এখন থেকে কমিয়ে পুনরায় সেইরকম দামে বিক্রি করার জন্য চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানান। এসময় তিনি চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য যেন বাড়ানো না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত বাজার মনিটর করার নির্দেশনা দেন।
সভায় উপস্থিত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান সরকারের যেন বদনাম না হয় সেজন্য ব্যবসায়ীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
এ সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজশাহী কার্যালয়ের উপপরিচালক ইব্রাহিম হোসেন, সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জান মোহাম্মদ বিভিন্ন অটোরাইস মিলের মালিক ও এর প্রতিনিধিগণসহ অন্যান্য চাল ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে অটোরাইস মিল মালিকরা সভায় জানান, ধানের দাম বাড়ায় তারা চালের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের অভিযোগ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় বহু লোক কোনো লাইসেন্স ছাড়াই প্রচুর ধান মজুত করে রাখেন। মিল মালিকরা যখন কৃষকের কাছে ধান না পায় তখন তাদের কাছে যায়। এই সুযোগে তারা ধানের দাম বেশি নেয়। ফলে বেশি দামে ধান কিনে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হয়।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে একপর্যায়ে ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র জিরাশাইল চালের দাম বেড়েছে, মোটা চালের দাম বাড়েনি বলে দাবি করেন। এদিকে মুনজুর অটোরাইস মিলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জেলার বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে চিকন চাল ৭৫ টাকা আর মোটা চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৪ টাকায়।
জেলার মিল মালিকরা জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বাজারে ধানের দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে স্বর্ণা ধানের দাম আগে ১ হাজার ১০০ টাকা ছিল, সেই ধান এখন কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ টাকা মণ। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরা ধানের। এই ধানের দাম প্রতিমণে বেড়েছে ২০০-২৫০ টাকা।
তারা বলছেন, ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বাড়াতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে- ভোটের পর হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে ওঠে চালের বাজার। জাতভেদে চালের দাম বেড়ে যায় কেজিপ্রতি ১০-১৪ টাকা পর্যন্ত। সদ্য শেষ হওয়া বছরে আমন ধানের রেকর্ড উৎপাদন হওয়ার পরও অস্বাভাবিক এই চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে বারবার দাবি করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা চালের দাম বৃদ্ধির জন্য কুষ্টিয়া, নওগাঁর পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাল মিল মালিকদের দায়ী করেছেন। ভোটের আগে থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিল মালিকরা ‘ধানের মজুত নেই’- অজুহাতে চালের দাম বাড়াতে চান। ভোটের পর তারা দাম বাড়িয়েও দেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুরাতন বাজারের সেলিম রাইস ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, চালের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও দাম বেড়ে গেছে। কাজেই বুঝে নিতে হবে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। মিলাররা নানা কারণ দেখান, কিন্তু মূলত দাম ইচ্ছা করে বাড়িয়েছেন তারা। আমাদেরও কিছু করার নেই। সরকার যদি সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং না করে তাহলে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খুচরা ব্যবসায়ীর দাবি ১৫ দিনের ব্যবধানে ধানের দাম বেড়েছে প্রতিমণে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা এ বাণী প্রচার করে মিল মালিকরাই সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। আমন ধান ওঠার পরপরই মিল মালিকরা তা কিনে মজুত করেন। এখন চাষির কাছে কোনো ধান নেই। ধান সব চলে গেছে মিলারদের কাছে। যেহেতু সব ধান মিলাররা কিনে মজুত করেছেন, তাই সবার আগে তারা ধানের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আগে ধানের দাম বাড়িয়েছেন। পরে সেই সুযোগে বাড়িয়েছেন চালের দাম। প্রতিবছরই এই কৌশলেই চালের দাম বাড়ানো হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অটোরাইস মিলমালিক সমিতির সভাপতি হারুন-অর-রশিদ জানিয়েছেন- এ জেলায় চালের কোনো সিন্ডিকেট নেই। হঠাৎ করেই ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়াতে হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে সদ্য শেষ হওয়া আমন মৌসুমে জেলার ৫ উপজেলায় ৫৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। জেলায় চালের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩শ মেট্রিকটন এবং উৎপাদন হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৪১১ মেট্রিকটন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের রাজধানী হলেও ধান উৎপাদনেও উদ্বৃত্ত একটি জেলা।
তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজার কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন মনে করেন, মিলমালিকদের কারসাজিতেই বেড়েছে চালের দাম।
তিনি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিলমালিকরা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ধান মজুত করছেন। মিলারদের যে পরিমাণ ধান মজুত করার অনুমতি রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ধান মজুত করে নিয়েছেন তারা। এখন বাজারে ধানের সংকট দেখিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছেন।
এ কর্মকর্তা তার সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বলেন, মজুত দেখতে চাইলে মিলারদের কেউ সহযোগিতা করেন না। এমনকি মিলের গুদামে ঢুকতেও দেওয়া হয় না তাদের।
এদিকে, চালের এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির সিন্ডিকেটে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫ অটোরাইস মিলমালিকের নাম এসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি দল এই ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইতোমধ্যে শনিবার বিকেলে জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর যৌথভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অতিরিক্ত মূল্যে চাল বিক্রির অভিযোগে অভিযান চালিয়ে মুনজুর অটো রাইস মিলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। এ ছাড়াও চালের দাম কমাতে জেলার মিলগুলোকে সতর্ক করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক গালিভ খাঁন জানান, সম্প্রতি চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাইস মিলগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এসময় আগের উৎপাদিত চাল অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রির অভিযোগে মুনজুর অটোরাইস মিলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বাকি মিলগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মনির হোসেন জানান, যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ধানে উদ্বৃত্ত একটি জেলা। পাশাপাশি ধান উৎপাদনের অন্যতম রাজধানী হলো পাশের জেলা নওগাঁ। সেখানে প্রতিবছর কেন সিন্ডিকেট করে মিলাররা চালের দাম বাড়াচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। তার দাবি জিরো টলারেন্স নীতিতে প্রত্যেকটি মিলে অভিযান চালালে মিলারদের ধানের সংকটের যে রুপকথা প্রচারিত হয় তা জনসম্মুখে ফাঁস হয়ে যাবে।