সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়’—যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘কাকাতুয়া’ কবিতার লাইন দুটি সবার জীবনেই ঘটে থাকে। ঘটেছে রোহিত শর্মার জীবনেও।
নিরঙ্কুশ ফেবারিট হয়েও ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি ভারত। আহমেদাবাদের ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শক আর ১৪০ কোটি ভারতীয়কে স্তব্ধ করে দিয়ে নিজেদের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয় করেছে অস্ট্রেলিয়া।
ফাইনালে ভারতীয়দের হৃদয়ভঙ্গের ২৪ দিন পেরিয়ে গেছে। নতুন রূপের ভারত এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টি–টোয়েন্টি সিরিজ খেলে ফেলেছে। সিরিজটা ৪–১ ব্যবধানে জিতেও নিয়েছে। বর্তমানে তারা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আরেকটি টি–টোয়েন্টি সিরিজ খেলছে। কিন্তু বিশ্বকাপের পর আর মাঠে দেখা যায়নি রোহিতকে। এমনকি ফাইনালে হার নিয়ে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি
কিন্তু ওই যে সেই কবিতার মতো রোহিতও তাঁর দুঃসময় পেছনে ফেলে এসেছেন। ফাইনালে হারের বেদনা ভুলে আবারও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে ভারতীয় অধিনায়কের জন্য বিদঘুটে পরিস্থিতি থেকে বের হওয়াটা যে মোটেও সহজ ছিল না, সেটা একবাক্যে স্বীকারও করে নিয়েছেন।
লন্ডনে ছুটি কাটিয়ে ভারতে ফেরার পর আজ নিজের ইনস্টাগ্রামে ৪ মিনিট ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন রোহিত। পরে তাঁর আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি মুম্বাই ইন্ডিয়ানসও এক্সে (সাবেক টুইটার) সেই ভিডিও আপলোড করেছে। সেখানেই উঠে এসেছে বিশ্বকাপ–পরবর্তী দিনগুলো কীভাবে পার করে এসেছেন।
বিশ্বকাপের পর প্রথমবার সরাসরি হৃদয় থেকে’ লেখা ক্যাপশনের ভিডিও বার্তার শুরুতে ৩৬ বছর বয়সী রোহিত বলেছেন, ‘কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রথম কয়েক দিন কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সে সময় আমার চারপাশের সবকিছু হালকা রাখার চেষ্টা করেছিল, যা বেশ সহায়ক ছিল। ওই হার হজম করা সহজ ছিল না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। এভাবেই এগিয়ে যায়। তাই সবকিছু ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে হয়। তবে সত্যি বলতে, এটা কঠিন ছিল।’
২০০৭ সালে ভারতের হয়ে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছেন রোহিত। কিন্তু আসল বিশ্বকাপ হিসেবে বিবেচিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ট্রফি এখনো অধরা। এবার খুব কাছে এসেও স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় একটু বেশিই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন রোহিত, ‘আমি ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ দেখেই আমি বড় হয়েছি। এবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে আমার জন্য পরম পাওয়া হয়ে থাকত। বিশ্বকাপ জয়ের জন্যই তো আমরা এতগুলো বছর পরিশ্রম করেছি। কিন্তু আপনি যা চান, তা যদি না পান, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা যদি পূরণ না হয়, তাহলে হতাশ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক।’
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচেই হেরে যায় অস্ট্রেলিয়া। সেই হার দুটি ফাইনাল আর সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই। তবে শুরুর ভুলগুলো শুধরে নিয়ে টানা ৯ ম্যাচ জিতে ঠিকই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বিপরীতে ভারত ফাইনালের আগপর্যন্ত ‘অজেয়’ ছিল। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। আহমেদাবাদে ফাইনালের মন্থর পিচে আগে ব্যাট করতে নেমে ২৪০ রানে আটকে যায় ভারত, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ট্রাভিস হেডের শতক আর মারনাস লাবুশেনের অপরাজিত অর্ধশতকে সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া। ওই পিচকে পরে ‘গড়পড়তা’ রেটিং দেয় আইসিসি।
ফাইনালে ভারত ঠিক কোথায় ভুল করেছিল, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি রোহিত। তবে তাঁর মনে হয়েছে, টানা ১০ ম্যাচ জিতে ফাইনালে ওঠাতেই অতীতের ভুলগুলো সেভাবে নজরে পড়েনি, ‘আমাদের দিক থেকে যা কিছু সম্ভব, সবই করেছি। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, কোথায় ভুল হয়েছিল; তাহলে বলব, আমরা প্রথম ১০ ম্যাচ জিতেছিলাম। ওই ১০ ম্যাচে যে ভুল করিনি, তা নয়। প্রতিটি ম্যাচেই কিছু না কিছু ভুল হয়। নিখুঁত ম্যাচ বলে কিছু হয় না। বড়জোর নিখুঁতের কাছাকাছি কিছু একটা হতে পারে।’
ফাইনালে হারের যন্ত্রণা ভুলতেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে গিয়েছিলেন রোহিত। বিদেশেও ভক্তদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন, ‘ওই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা (ফাইনালে হারের যন্ত্রণা) আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এমন কোথাও যাওয়া প্রয়োজন, যাতে আমার মনকে এসব থেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু পরে খেয়াল করলাম, আমি যেখানেই যাই, সেখানেই মানুষ আমার কাছে আসতে থাকে। দলের প্রত্যেকের পারফরম্যান্সের প্রশংসা করতে থাকে। তারাও আমাদের হাতে বিশ্বকাপ দেখতে চেয়েছিল। তাদের জন্য আমার খারাপ লেগেছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভারতের টি–টোয়েন্টি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সূর্যকুমার যাদব, ওয়ানডে সিরিজে অধিনায়কত্ব করবেন লোকেশ রাহুল। রোহিত ফিরবেন টেস্ট সিরিজ দিয়ে। ভারতে কিছুদিন প্রস্তুতি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন রোহিত। প্রথম টেস্ট শুরু ২৬ ডিসেম্বর।