পুরান ঢাকার শ্যামবাজার থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা প্যারিদাস রোড। এ সড়কের দুই পাশে খুচরায় বিক্রি হয় শাক-সবজি। কেউ দোকান বসিয়ে, কেউ বা ভ্যানে বিক্রি করেন। এসব জায়গা থেকেই সাধারণত সবজি কেনে মানুষ। পাইকারি থেকে কিনে খুচরা বিক্রেতারা যখন সবজি অলিগলিতে নিয়ে যান, তখনই দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ফলে খুচরায় কোনো সবজিই ৭০-৮০ টাকার নিচে মেলে না। আবার কোনো কোনো সবজি তো ১০০ টাকার ওপরে।
শ্যামবাজারে গিয়ে দেখা যায়, লালকুঠি ঘাট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে পাইকারিতে শাক-সবজি বেচাকেনা চলছে। পুরান ঢাকা ও আশপাশের খুচরা ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সবজি কিনে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে বিক্রি করেন।
শুরুতেই যেনে নেওয়া যাক শ্যামবাজারের পাইকারিতে কত করে বিক্রি হচ্ছে শাক-সবজি। এই দর ১৪ অক্টোবর বাজার ঘুরে জানা যায়।
এতে দেখা যায়, শ্যামবাজারের পাইকারিতে লালশাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। এছাড়া শাপলা ১০, কলমি ও পুঁইশাকের আঁটিপ্রতি দাম ১৫ টাকা।
আরও পড়ুন: আলু-পেঁপে ছাড়া কিছুই মিলছে না ৮০ টাকার নিচে
এ বাজারে সবজির মধ্যে শিম ১২০ ও বেগুন ৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এছাড়া করলা, কচুমুখী ও বরবটি- এই তিন সবজির কেজি ৮০ টাকা। আর পটোল, কাঁকরোল ও গাজর ৭০ টাকা কেজি। ঢ্যাঁড়শ ৬০, চিচিঙ্গা ৬০, ধুন্দল ৬০, মুলা ৫০, লতি ৫০, কুমড়া ৩০ ও পেঁপে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে পাইকারিতে এসব সবজি সর্বনিম্ন কিনতে হয় পাঁচ কেজি। এদিকে কলার হালি ৩০ আর লাউ ৬০ টাকায় বিক্রি হয় শ্যামবাজারে।
এই তো গেলো শ্যামবাজারের পাইকারির কথা। এবার দেখা যাক স্থানীয় খুচরা বাজারের চিত্র।
নারিন্দা কাঁচাবাজারে সবজির মধ্যে কম দামে ৩০ টাকায় শুধু পাওয়া যাচ্ছে পেঁপে। আর বাকি প্রায় সব সবজিই ১০০ টাকা কেজি। যেমন খুচরায় করলা মানভেদে ১০০-১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অথচ এটা পাইকারিতে ৮০ টাকা কেজি। শিম ১৫০ টাকা, পাইকারিতে এই সবজির দাম ১২০ টাকা।
বেগুন খুচরায় ১৪০ আর পাইকারিতে ৯০ টাকা। পটোল খুচরায় ১০০ ও পাইকারিতে ৭০ টাকা। বরবটি এবং কচুমুখী খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, যা পাইকারিতে ৮০ টাকা। এছাড়া এক কেজি ভেন্ডি কিনতে গুনতে হচ্ছে ৭০ টাকা। ধুন্দল ৮০-৯০ টাকা, যা পাইকারিতে ৬০ টাকা। সব মিলিয়ে পাইকারি থেকে খুচরায় দাম ৩০-৪০ টাকা বেশি।
এদিকে প্যারিদাস রোডের দুই পাশে খুচরায় বিক্রি হয় শাক। এরমধ্যে লালশাক বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা দরে। শাপলার আঁটি ২০ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা ও কলমি ২৫ টাকা। শাকেও খুচরায় ১০-১৫ টাকা বেশি রাখা হচ্ছে।
অপরদিকে টায়ারপট্টিতে ভ্যানে শ্যামবাজারের শাক বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। ১০ টাকার লালশাক এখানে ২০ টাকা। শাপলা ২০, পুঁই ৩০ ও কলমি শাক ২০ টাকা।
দাম বেশি রাখার বিষয়ে নারিন্দা কাঁচাবাজারের সবজির খুচরা ব্যবসায়ী আলমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আড়তেই সবজির দাম চড়া। সেখানে বেশিরভাগ সবজি ৬০-৭০ টাকা। আমরা সরাসরি ব্যাপারী থেকে আনতে পারি না। আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। সকালে সদরঘাটে নৌকায় সবজি এলে আড়তদারদের মাধ্যমেই কিনতে হয়। ফলে মাঠের দামের চেয়ে আড়তে এসে দাম হয় দ্বিগুণের বেশি।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেমন কলমি ও লালশাকের আঁটি মাঠে পাঁচ টাকা। কিন্তু শ্যামবাজারে এসেই হয়ে যাচ্ছে ১০-১৫ টাকা। ১৫ টাকা দিয়ে কিনে আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে ২০-২৫ টাকায়।
রায়সাহেব বাজারের আরেক খুচরা ব্যবসায়ী আরিফ বলেন, বৃষ্টির কারণে সবজি কম আসে। ফলে শ্যামবাজারে সরবরাহ কম। তাই দামও বেশি। আমরা আড়ত থেকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে সবজি নিয়ে আসি। খরচ পুষিয়ে পাইকারির চেয়ে সামান্য বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। আড়তে কম দামে পেলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতাম।
এদিকে ব্যবসায়ীরা যাই বলুক না কেন, সবজির এমন অসহনীয় দামে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। বজলুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, গত এক বছর থেকে সবজির বাজারে এই অবস্থা। আমরা শহরের মানুষ নিরুপায় হয়ে কিনতে হচ্ছে। শ্যামবাজারে গেলে মোটামুটি কম দামে কিনতে পারি সবজি। কিন্তু এলাকার বাজারে ন্যূনতম ৮০-৯০ টাকার নিচে কোনো ভালো সবজি নেই।
শ্যামবাজারে মূলত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে সবজি আসে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের নওগাঁ, রাজশাহী, বগুড়া, মুন্সিগঞ্জ, কেরানীগঞ্জের সাতারচর, চান্দিরচর, আটিবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়মিত সবজি আসে এ বাজারে। রাত ১টার পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত আসতে থাকে সবজি।
শ্যামবাজারের সবজির পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে আসতেই দাম বেড়ে যায় অর্ধেক। কৃষকের ক্ষেত থেকে ব্যাপারীদের ফসল তুলে আনা ও নৌকাযোগে সদরঘাট আনতে খরচ বেড়ে যায়। সেখান থেকে দাদনের মাধ্যমে আড়তদাররা নিলে তারা আবার দাম বাড়িয়ে দেন।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, শ্যামবাজার আগের তুলনায় ছোট হয়ে যাচ্ছে। যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারে আড়ত হওয়ার পর সবজি কম আসে শ্যামবাজারে।
শ্যামবাজারের কচুমুখীর আড়তদার শাহ আলম জাগো নিউজকে বলেন, কৃষকের মাঠ থেকে কম দামে সবজি কিনলেও জেলা শহর বা উপজেলার মোকামে এসে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেখান থেকে ঢাকা আসার পথে গুলিস্তানসহ বিভিন্ন জায়গায় আবার দিতে হয় চাঁদা। ফলে খরচ আরও বেড়ে যায়।
দাম বাড়ার বিষয়ে শ্যামবাজারের কর্ণফুলী বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার সাইফুল জাগো নিউজকে বলেন, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির কারণে মাঠে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কম আসছে মাল। কম এলে দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া জেলার স্থানীয় আড়তদাররা মোকাম থেকে দাম বাড়িয়ে দেন। আমরা তো বস্তা হিসেবে ১-২ টাকা লাভে বিক্রি করি। আর কম নিলে ৪-৫ টাকা লাভে বিক্রি করি। এর বেশি না।
সবজির দাম নিয়ে এত হেরফেরের বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার মধ্যে অলিগলিতে খুচরা বাজারের অভাব নেই। সব জায়গায় আমাদের অভিযান সম্ভব নয়। কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেন, তাহলে অভিযান পরিচালনা করবো। তবে পাইকারি বাজারগুলোতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। পাইকারি বাজারে যদি সবজির দাম কমে, তাহলে খুচরাতেও কমবে।