মাদকসেবীদের অর্ধেকের বেশি কিশোর–তরুণ

মাদকসেবীদের অর্ধেকের বেশি কিশোর–তরুণ

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের মধ্যে কিশোর ও তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গত আট বছরের তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।

ডিএনসির সর্বশেষ মাদকবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ১ হাজার ৩২৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৯১৫ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। সে হিসাবে সেখানে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৬৯ শতাংশ কিশোর ও তরুণ।

এর আগে ২০১৫ থেকে ২০১৮ মেয়াদে কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেন ২ হাজার ৮৫৩ জন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৬৮২ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর, অর্থাৎ প্রায় ৫৯ শতাংশ কিশোর ও তরুণ।

দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট চারটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় তিনটি আঞ্চলিক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ডিএনসির নিরোধ শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশে মাদকসেবীদের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো সমীক্ষা নেই। কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণে যে চিত্র পাওয়া গেছে, এটাই বাস্তব চিত্র বলে তাঁরা মনে করছেন, অর্থাৎ মাদকসেবীদের অধিকাংশই কিশোর ও তরুণ বয়সে মাদকে আসক্ত হচ্ছেন।

ডিএনসির প্রতিবেদন বলছে, বয়স বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হচ্ছে ১৫-২৫ বছর। চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৪১ শতাংশই এই বয়সী। তাঁরা মূলত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কৌতূহল ও বন্ধুদের বিশ্বাস করার প্রবণতাও তাঁদের মধ্যে অনেক বেশি। ফলে এই বয়সে অনেকেই মাদক সেবনে যুক্ত হয়ে পড়েন। আর ২৫ থেকে ৩০ বয়সী ব্যক্তিদের অনেকে শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভোগেন। তাঁদেরও কেউ কেউ মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়েন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শাখা) মানজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কৌতূহল ও বন্ধুর প্ররোচনা ছাড়াও তরুণদের অনেকে হতাশায় ভোগেন। বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণেও কেউ কেউ মাদকাসক্ত হন। আবার প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবন গুছিয়ে নিতে না পেরে মাদকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকে।

ডিএনসির সর্বশেষ মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক রুট গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা) এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) কাছাকাছি। এ কারণে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে। তা ছাড়া দেশের ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এসব জেলায় অনেক সীমান্ত অরক্ষিত। এসব সীমান্ত দিয়ে হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত বিভিন্ন ধরনের মাদক আসছে। শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় এসব মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক।

গত পাঁচ বছরে দেশে কয়েক ধরনের অপ্রচলিত মাদক ধরা পড়েছে। ডিএনসির মাদক উদ্ধারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ফেনইথাইলামিন (দেখতে কোকেনের মতো), এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড), ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন বা ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুম এবং খাত (ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমিতে জন্মানো একধরনের উদ্ভিদের পাতা), ‘কুশ’, ‘এক্সট্যাসি’, ‘হেম্প’, ‘মলি’। মারিজুয়ানা শ্রেণির উদ্ভিদের সবচেয়ে উন্নত জাত কুশ। হেম্পও মারিজুয়ানা থেকে তৈরি মাদক। এক্সট্যাসি, মলি ও এডারলের মূল উপাদান অ্যামফিটামিন, যা ইয়াবা তৈরিরও মূল উপাদান।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মাদক আসার মূল কারণ মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সক্ষমতা নেই বলেও তিনি মনে করেন। প্রথমে মাদক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতনও হতে হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS