শেন ওয়ার্নের ক্রিকেট ক্যারিয়ার যতটা বর্ণিল, মাঠের বাইরের জগৎটা ছিল ততটাই বিতর্কিত। বলটাকে নিজের ইচ্ছেমতো ঘোরানোর পাশাপাশি অসংখ্য নারীকেও ঘুরিয়েছেন। কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার প্রয়াত কিংবদন্তির এসব বিতর্কিত অধ্যায়সহ আরও কিছু ঘটনা নিয়ে গত বছর একটি টিভি সিরিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল দেশটির টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল নাইন।
প্রাথমিকভাবে দুই পর্বের সেই টিভি সিরিজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিয়ন্ড ডিসরেসপেক্টফুল’। কিন্তু ওয়ার্ন মারা যাওয়ার মাত্র ছয় মাসের মাথায় তাঁকে নিয়ে এমন বায়োপিক বানানোয় প্রতিবাদ জানিয়েছিল তাঁর পরিবার। পরবর্তী সময়ে পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ওয়ার্নি’। তবে ওয়ার্নের জীবনের বিতর্কিত বিষয়গুলো বায়োপিকে ঠিকই রাখা হয়েছে।
টিভি সিরিজটিতে ওয়ার্নের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যালেক্স উইলিয়ামস, তাঁর সাবেক স্ত্রীর চরিত্রে মার্নি কেনেডি আর সাবেক বাগদত্তা লিজ হার্লির চরিত্রে শান্তি কালি। শুটিংয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে কদিন আগে আহতও হয়েছিলেন অভিনেতা উইলিয়ামস ও অভিনেত্রী কেনেডি। চিকিৎসা নিতে হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল তাঁদের। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই শুটিং সম্পন্ন হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী রোববার টিভি সিরিজটির প্রথম পর্ব ও সোমবার দ্বিতীয় পর্ব প্রচার করবে চ্যানেল নাইন।
ওয়ার্নকে নিয়ে বানানো টিভি সিরিজটি প্রচারের আগে তাঁর পরিবারকে আলাদাভাবে দেখানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব পরিবারের সদস্যরা নাকচ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ দৈনিক সিডনি মর্নিং হেরাল্ড। চ্যানেল নাইন আর সিডনি মর্নিং হেরাল্ড একই মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম।
স্ত্রী সিমোন কালাহানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বাবা–মা এবং তিন সন্তান জ্যাকসন, ব্রুক ও সামারকে নিয়ে থাকতেন ওয়ার্ন। তবে চ্যানেল নাইন–এর কর্মকর্তারা সাবেক স্ত্রী কালাহানকেও টিভি সিরিজটি দেখার আমন্ত্রণ জানান। ওয়ার্নের পরিবারের মতো কালাহানও সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। ট্যাবলয়েড পত্রিকা হেরাল্ড সানকে তিনি বলেন, ‘এটা কিছুটা নির্মম ও কুরুচিপূর্ণ। সে (ওয়ার্ন) কিছুদিন আগে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। ওকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। আমার বিশ্বাস, সন্তানেরাও এ ব্যাপারে কোনো সহানুভূতি দেখাবে না।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই পর্বের টিভি সিরিজটি প্রচারের ঘোষণা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জনসাধারণেরও তোপের মুখে পড়েছিলেন চ্যানেলটির নির্বাহী কর্মকর্তারা। সে সময় ওয়ার্নের বড় মেয়ে ব্রুক চ্যানেল নাইন কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ করে ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন, ‘আমার বাবা বা তাঁর পরিবারের প্রতি আদৌ কি আপনাদের সম্মানবোধ আছে? তিনি চ্যানেল নাইন–এর জন্যও কত কিছু করেছেন।’ খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় বলার পর টিভি চ্যানেলটির ধারাভাষ্যকার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন ওয়ার্ন। তাঁর মেয়ে ব্রুক সেটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন।
ব্রুকের সেই পোস্টের পর ওয়ার্ন পরিবারের সঙ্গে চ্যানেল নাইন কর্তৃপক্ষের সম্পর্কের উন্নতি হয়। ডিসেম্বরে ব্রুক জানান, তাঁর পরিবারের সঙ্গে অনুষ্ঠানের প্রযোজকদের দেখা হয়েছে, ‘তাঁদের সঙ্গে আমরা দেখা করেছি। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। (টিভি সিরিজ) প্রচারের পর দেখব কী হয়।’
ওয়ার্নের সাবেক ম্যানেজার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেমস এর্সকিনও চ্যানেল নাইন কর্তৃপক্ষের তীব্র সমালোচনা করেছেন, ‘চ্যানেল নাইন আমার মাধ্যমেই সবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। চ্যানেলটিকে এত দিন যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়েছে। কিন্তু (ওদের বোঝা উচিত) প্রত্যেকের ভিন্ন মতামত থাকতে পারে। ওদের মনে রাখা উচিত ছিল এটা একটা নাটক, ঐতিহাসিক প্রামাণ্যচিত্র নয়। ওদের লজ্জা হওয়া উচিত।’
বিংশ শতাব্দীর সেরা বলটি ওয়ার্নের হাত থেকেই বেরিয়েছিল। মনে করা হয়, লেগ স্পিন শিল্পের সবচেয়ে নিখুঁত শিল্পী তিনি। তবে স্ত্রী কালাহানের কাছে কখনোই নিখুঁত স্বামী হতে পারেননি। শেষমেশ তাঁদের সংসারটা ভেঙে গেছে। ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যাশেজের প্রথম বলটা লেগ স্টাম্পের বাইরে ফেলার পর অবিশ্বাস্য বাঁক খাইয়ে বোল্ড করেছিলেন মাইক গ্যাটিংকে। ব্রিটিশ মিডিয়ার কল্যাণে যেটা ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’র মর্যাদা পেয়েছে। টিভি সিরিজে ক্রিকেট ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তটা যেমন দেখানো হবে, একই সঙ্গে দেখানো হবে স্ত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করে ওয়ার্নের অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও।
ওয়ার্নের জীবনের আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে আছে ডোপ নিয়ে নিষিদ্ধ হওয়া। ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ায় ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরুর আগে দিন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। পরে ওয়ার্ন জানান, ওজন কমাতে তাঁর মায়ের দেওয়া ওষুধ ব্যবহার করেছিলেন। টিভি সিরিজের একটি দৃশ্যে সেই কাহিনিও তুলে ধরা হয়েছে।
সবাইকে চমকে দিয়ে ২০০৭ সালে আবার ওয়ার্নের কাছে ফেরেন সাবেক স্ত্রী কালাহান। চেয়েছিলেন, নতুন করে সংসার সাজাতে। ভেবেছিলেন, ওয়ার্ন বোধ হয় নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ওয়ার্ন শোধরালে তো! এ দফায় অন্য নারীকে কামোত্তেজক বার্তা পাঠাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কালাহানের ফোন নম্বরে পাঠান। তাঁর ধোঁকাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে এরপর সেই যে চলে গেছেন, আর ফেরেননি কালাহান।
কালাহানের সঙ্গে পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদের পর ব্রিটিশ মডেল ও অভিনেত্রী হার্লির প্রেমে পড়েন ওয়ার্ন। ২০১১ সালে বাগদানও সারেন তাঁরা। তবে দুই বছর যেতেই এ জুটিরও ভাঙন ধরে। ওয়ার্নের বায়োপিকে হার্লির চরিত্রে অভিনয় করেছেন লন্ডনে জন্ম নেওয়া অভিনেত্রী কালি। ২০১০ সালে লন্ডনের ওয়ার্নের হোটেলের বাইরে পাপারাজ্জিদের ক্যামেরায় ধরা পড়েন ওয়ার্ন ও লিজ। সেই দৃশ্যও উঠে এসেছে টিভি সিরিজে।
বায়োপিকে ওয়ার্নের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করছেন অভিনেতা উইলিয়ামস। হেরাল্ড সানকে বলেছেন, ‘ওয়ার্নের জীবনের ২৫ বছর অভিনয় করে ফুটিয়ে তোলাটা কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু এখন তাঁকে মানুষ হিসেবে আরও গভীরভাবে জানতে পেরেছি।’