নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নির্বাচনী জনসভার শেষ দিনে এক নারী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল এমন এক অমর বাক্য, যা পরবর্তী তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই তেজস্বী কণ্ঠে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছিলেন— ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা’।
আজ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার প্রবক্তা আর নেই। কিন্তু তার সেই বাক্য আজও কোটি মানুষের হৃদয়ে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মন্ত্র হিসেবে অনুরণিত হচ্ছে।
সেই ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে আজীবনের আপসহীন সংগ্রাম— বেগম খালেদা জিয়া কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের এক জীবন্ত প্রতীক।
১৯৯০-এর শেষ দিকে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতনের পর দেশ যখন নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। সেই নির্বাচনী প্রচারণার শেষ পর্যায়ে বেগম জিয়া তার ভাষণে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, একপক্ষ বিদেশের শক্তির কাছে নতজানু হয়ে গোলামির জিঞ্জির পরে আছে, আর অন্যপক্ষ সাধারণ মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনতার পতাকাকে সমুন্নত রাখতে চায়।
এই একটি বাক্য দিয়েই তিনি সে সময়কার তরুণ প্রজন্ম ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের মনে জাতীয়তাবাদের বীজ বুনে দিয়েছিলেন।তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত ঢাকাতেই হবে, অন্য কোনো দেশের রাজধানীতে নয়। তার এই ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ দর্শনই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে অভাবনীয় জয় এনে দিয়েছিল এবং তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন’ উপাধিটি কোনো অলংকার নয়, বরং তার কর্মের স্বীকৃতি। ১৯৮২ সালে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর যখন অনেক বাঘা বাঘা নেতা সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়েছিলেন, তখন বেগম জিয়া একচুলও নতিস্বীকার করেননি।
১৯৮৬ সালের ‘পাতানো’ নির্বাচনে অংশ নিতে যখন অনেক রাজনৈতিক দল প্রলুব্ধ হয়েছিল, তখন তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জনগণ ভোট দিতে পারবে না এমন কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। তার এই অবিচল অবস্থানের কারণেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধানতম শক্তি। বারবার গৃহবন্দি, গ্রেপ্তার এবং রাজপথে টিয়ারগ্যাস-লাঠিপেটা সহ্য করেও তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই থেকে পিছু হটেননি।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস না করা।বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তরবঙ্গের মরুভূমি হওয়ার উপক্রম হওয়া, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচারে বাংলাদেশি হত্যা, কিংবা তিস্তা চুক্তির অনিশ্চয়তা— প্রতিটি ইস্যুতে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ও রাজপথে লড়াই করেছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন, বন্ধুত্ব হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে, দাসত্বের ভিত্তিতে নয়। তার সরকারের আমলেই ট্রানজিট বা করিডোর দেওয়ার বিনিময়ে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছিল। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন যে, এটি কেবল পানির অধিকার নয়, এটি বাংলাদেশের বেঁচে থাকার অধিকার। তার এই শক্ত অবস্থানের কারণেই দেশপ্রেমিক জনগণের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘দেশের অতন্দ্র প্রহরী’।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৭ সালের ১/১১-এর সময়। তৎকালীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নে মরিয়া, তখন তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল—যদি তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান, তবে তার ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দেওয়া হবে না। কিন্তু সেই সময় তিনি যে কথাটি বলেছিলেন, তা আজও ইতিহাসের অংশ— “দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।” কারাগারে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়েছেন, ছেলেদের ওপর নির্মম নির্যাতন দেখেছেন, কিন্তু নিজের আদর্শ ও মাটিকে ছেড়ে পালাননি। ১/১১-এর সেই দুঃসময়ে তার এই একগুঁয়ে দেশপ্রেমই মূলত বাংলাদেশের বিরাজনীতিকরণের নীলনকশাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল।
খালেদা জিয়া বারবার একটি কথা বলতেন— ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতা বন্দুকের নলে নয়, বরং ব্যালট বাক্সে থাকে। তার শাসনামলে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে জরাজীর্ণ কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। বছরের পর বছর নির্জন কারাবাস, সুচিকিৎসার অভাব এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পরও তার কণ্ঠস্বর ছিল গণতন্ত্রের সপক্ষে অবিচল।
দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি রাজনৈতিক জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি চিরবিদায় নিলেন। ১৯৯১ সালে দেওয়া সেই স্লোগান— ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা’, আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সময়ে যখন আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও আধিপত্যবাদের চাপ তীব্রতর, তখন খালেদা জিয়ার সেই অদম্য সাহস ও দৃঢ়তা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তিনি কেবল তিনটি নির্বাচনের অপরাজিত নেত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কোটি মানুষের আবেগ ও আস্থার ‘মা’। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল এক অজেয় জাতীয়তাবাদী কণ্ঠস্বরকে। ইতিহাসের পাতায় তিনি অমর হয়ে থাকবেন এমন একজন নেত্রী হিসেবে, যিনি কখনো মাথা নত করেননি, না স্বৈরাচারের কাছে, না কোনো বিদেশি শক্তির কাছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির দিগন্তে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নিভে গেলেও, তার দর্শনের পতাকা আজ কোটি মানুষের হাতে। যে পতাকাকে তিনি আজীবন আগলে রেখেছিলেন, সেই লাল-সবুজের পতাকার নিচেই আজ তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হতে যাচ্ছেন। তার বিদায়ে একটি সোনালি যুগের অবসান হলো।