ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশ নিয়ে দ. এশিয়ায় নতুন জোট গড়তে চায় পাকিস্তান

ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশ নিয়ে দ. এশিয়ায় নতুন জোট গড়তে চায় পাকিস্তান

ভারতকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন আঞ্চলিক জোট গড়তে চায় পাকিস্তান। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন, এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হওয়া ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা দ্রুতই বিস্তৃত হয়ে আরও দেশকে যুক্ত করতে পারে।

বুধবার ইসলামাবাদে ‘ইসলামাবাদ কনক্লেভে’ তিনি বলেন, পাকিস্তান ‘জিরো–সাম’ (শূন্য-সমষ্টিগত) কূটনীতির বিরোধী এবং সংঘাত নয়, সহযোগিতায় বিশ্বাসী। তার মতে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রচলিত আঞ্চলিক কাঠামো যখন স্থবির, তখন বিকল্প উদ্যোগ সময়ের দাবি।

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান সংস্থা সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওনাল কো-অপারেশন বা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বহু বছর ধরে। সার্কে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান। সার্ক অচল হওয়ার বড় কারণ হিসেবে ভারত–পাকিস্তান বৈরিতাকেই দেখা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ কাঠামোগত সংলাপ বন্ধ আছে ১১ বছরেরও বেশি সময়।

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক উত্তেজনাও বেড়েছে। চলতি বছরের মে মাসে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চার দিনের সীমিত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ করেছে।

এদিকে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কেও বড় ফাটল ধরেছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। গত নভেম্বরে বাংলাদেশে একটি ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

এই জটিল প্রেক্ষাপটে ভারতকে ছেঁটে ফেলে পাকিস্তানের নতুন আঞ্চলিক উদ্যোগকে অনেকেই ভারতের প্রভাব সীমিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। এ পরিস্থিতিতে সার্কের বাকি দেশগুলো নতুন আঞ্চলিক জোটকে মেনে নেবে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাকিস্তানের পরিকল্পনা কী?
ইসহাক দার বলেন, চীন ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক এই সহযোগিতা অভিন্ন স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোয় ‘পারস্পরিক উপকারিতা’ বাড়ানোর লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে। অর্থনীতি, প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও বিভিন্ন খাতে ভিন্ন ভিন্ন গঠনের আঞ্চলিক জোট হতে পারে। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কারও একগুঁয়েমির কাছে জিম্মি হতে পারে না। তার বক্তব্য যে ভারতকে উদ্দেশ্য করে, তা পরোক্ষভাবেই স্পষ্ট।

তিনি দাবি করেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে, যেখানে বিভাজনের জায়গায় সংযোগ গড়ে উঠবে, বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হবে, এবং মর্যাদার সঙ্গে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাঠামোগত আলোচনার প্রক্রিয়া ১১ বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে আছে; তা ছাড়া সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোরও  ‘আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দোদুল্যমান সম্পর্কের’ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, পাকিস্তান এমন একটি দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে বিভাজনের জায়গায় যোগাযোগ ও সহযোগিতা স্থান নেবে, অর্থনীতিগুলো পারস্পরিক সমন্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুসারে শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধের সমাধান হবে এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকবে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিকতা শুধু স্বপ্ন নাকি বাস্তবও হতে পারে?
লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসএসপিআর-এর পরিচালক রাবিয়া আখতারের মতে, পাকিস্তানের প্রস্তাব এখনই বাস্তবায়নের চেয়ে বরং অভিপ্রায়ের ঘোষণা। তিনি বলেন, সার্ক স্থবির হয়ে পড়ায় পাকিস্তান আঞ্চলিক সহযোগিতা নতুনভাবে কল্পনা করতে চাইছে।

১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে লক্ষ্য করেছিল। তবে ভারত–পাকিস্তানের টানাপোড়েনের কারণে সংস্থাটি কখনো পূর্ণভাবে কার্যকর হতে পারেনি। সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে ১৯ তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু ভারত শাসিত কাশ্মীরে এক প্রাণঘাতী হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত সম্মেলন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

রাবিয়া এই সংস্থাটির কাজ করার জন্য ঐকমত্যের প্রয়োজন, আর দুটি বৃহত্তম সদস্য দেশের কাছ থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ থেকে আলাদা রাখার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সার্ক সামনে এগোতে পারে না।

বিশ্লেষকেরা বলেন, সার্ক নিষ্ক্রিয় থাকলেও এই অঞ্চলের জন্য কাজ করার সম্ভাবনা তার আছে–যদি ভারত ও পাকিস্তান তাদের সেই সুযোগ দেয়। ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্বের দুই বিলিয়নেরও বেশি মানুষ বসবাস করে, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল করে তুলেছে।

অঞ্চলজুড়ে বাণিজ্য–সংযোগ: বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে দক্ষিণ এশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য খুবই কম, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের একটি জোট আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ। আসিয়ান জোটের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমাতে পারলে দক্ষিণ এশিয়া তিনগুণ বেশি পণ্য বিনিময় করতে পারে ৬৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু আঞ্চলিক সংযোগ অপ্রতুল হওয়ায় সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

ভারত–পাকিস্তানের বাণিজ্য বিশেষভাবে দুঃসহ। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে তাদের বাণিজ্য ছিল মাত্র ২.৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে তা নেমে যায় ১.২ বিলিয়নে। তৃতীয় দেশ ঘুরে দুই দেশের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য ১০ বিলিয়ন ডলার বলেও অনেকে মনে করেন।

২০১৪ সালে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গাড়ি–ট্রাক চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল সার্ক। কিন্তু উত্তেজনার কারণে পাকিস্তান তা আটকে দেয়। রেল সহযোগিতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।

তাহলে কি পাকিস্তানের নতুন জোট সফল হবে?
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শহাব এনাম খান মনে করেন, উদ্যোগটি উচ্চাভিলাষী হলেও সময়োপযোগী। দক্ষিণ এশিয়া বারবার নিরাপত্তা রাজনীতির ফাঁদে আটকে বাস্তববাদী আঞ্চলিকতা গড়তে ব্যর্থ হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রভীন দোণ্তি বলেন, সার্কের অচলাবস্থা নতুন ফোরামের জন্য শূন্যতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চীন–পাকিস্তান–বাংলাদেশের ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতায় তার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তাব সফল হবে কি না তা নির্ভর করছে সম্ভাব্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর। তারা ইস্যুকেন্দ্রিক জোটকে কতটা কার্যকর মনে করে ও এতে যোগ দিলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের রাজনৈতিক মূল্য কতটা পড়বে, সেটিও বিবেচ্য।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান প্রাথমিক পর্যায়ে আগ্রহ দেখাতে পারে, বিশেষ করে যোগাযোগ, জলবায়ু অভিযোজন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো ইস্যুতে। তবে ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা বিবেচনায় আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ পেতে তারা সতর্কই থাকবে।

পাকিস্তানের কূটনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের ফারওয়া আমের মতে, পাকিস্তানের প্রস্তাব কৌশলগতভাবে সুসংগত। তার মতে, চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেই ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করেছে যা তাদের নতুন ভূরাজনৈতিক আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।

তিনি বলেন, এই দ্বৈত কূটনীতি পাকিস্তানকে নতুনভাবে আঞ্চলিক মঞ্চে নিজেদের স্থান ফিরে পাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS