তোফাজ্জলকে বেশি মেরেছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জালাল

তোফাজ্জলকে বেশি মেরেছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জালাল

ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনায় কয়েকজনের পরিচয় সনাক্ত হয়েছে।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, তোফাজ্জলকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছেন ছাত্রলীগের হল শাখার উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক থেকে পদত্যাগকৃত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ।তার সঙ্গে আরও কয়েকজন এতে জড়িত।

তারা হলেন- মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ, ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনিস্টিউটের মোত্তাকিন সাকিন, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের রাশেদ কামাল অনিক, গণিত বিভাগের রাব্বি এবং সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল। তারা সবাই তফাজ্জলকে মারধরে অংশ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হলের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বুধবার হলের খেলা চলাকালীন ৬-৭টি মোবাইল চুরি হয়। রাত ৮টার দিকে তোফাজ্জল হলে প্রবেশ করলে কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে চোর সন্দেহে আটক করে অতিথিকক্ষে নিয়ে যায় এবং মারধর করে। পরে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ানো হয়। এরপর তাকে আবারও হলের অতিথিকক্ষে এনে জানালার সাথে বাঁধা হয়। এসময় তাকে লাঠি ও স্ট্যাম্প দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়। মানসিক ভারসাম্যহীন জানার পরও তাকে ছাড়া হয়নি। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে তফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তোফাজ্জলের বাড়ি বরিশালের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠাল তলি ইউনিয়নে। তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তিনি প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন বলে জানা গেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জল স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাথাড়ি মারছেন। কেউ লাথি মারছেন। কেউ হাত দিয়ে কিল-ঘুষি দিচ্ছেন। মারধরের কারণে তফাজ্জলের সমস্ত শরীরে কালশিটে দাগ পড়ে যায়। তার শরীরের কোনো অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে দেখা গেছে।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী অনবরত তোফাজ্জলের হাতে আঘাত করছেন। পাশ থেকে কয়েকজন বলছেন, ‘হাতটা ভেঙে দে। ’ আরেকটি ভিডিওতে জালাল আহমেদকে মারধর করতে দেখা যায়। তিনি তোফাজ্জলের হাত ফ্লোরের উপর রেখে তার উপর স্ট্যাম্প রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন তোফাজ্জলের আঙুল অকেজো হয়ে পড়ে।

অবশ্য ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে মারধরে অংশ নেননি বলে দাবি করেছেন জালাল আহমেদ।

হলের এক প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমে গেস্টরুমে তাকে বেশি মারা হয়নি। ক্যান্টিন থেকে খাইয়ে তাকে এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ত্রিশের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। দুই-তিনজন মিলেই তোফাজ্জলকে ওখানে মেরে ফেলছে। এরা হলেন— মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ২০-২১ সেশনের মোহাম্মদ সুমন, ওয়াজিবুল, ফিরোজ ও জালাল। এদের মধ্যে সুমন, ফিরোজ এবং জালাল সবচেয়ে বেশি মেরেছে। গেস্ট রুমে তোফাজ্জলের হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাকে, মারতে মারতে ও (তোফাজ্জল) পড়ে গেছে।

এই শিক্ষার্থী বলেন, জালাল এসে গ্যাসলাইট দিয়ে তার পায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে সুমন তার চুল ও ভ্রু কেটে দেয়। তাকে মারধর করা হয়েছিল ফোন চুরির স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার পরও তাকে ছাড়া হয়নি। আবাসিক শিক্ষকরাও বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হন।

মূল ভবনের গেস্টরুমে নেওয়ার পর জালাল তাকে প্রচুর মারধর করা হয়।   এসময় তার আঙুল মাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

একপর্যায়ে তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়ে। এর আগে কোনো শিক্ষকও এসে তাকে বাঁচাতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলা

এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এজাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অ্যাডভাইজার আমানুল্লাহ উল্লেখ করেন, ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ৭টা ৪৫ মিনিটে একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাকে আটক করে। তাকে প্রথমে হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে সে মোবাইল চুরি করেছে বলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি দেওয়া হয়। জিজ্ঞাসা করলে তার নাম তোফাজ্জল বলে জানায়। পরে সে মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে হলের ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে হলের গেস্টরুমে নিয়ে জানালার সাথে পেছনে হাত বেধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে সে অচেতন হয়ে পড়ে। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানানো হলে তারা সহায়তা করে অচেতন যুবককে ঢামেকে নিয়ে যায়। পরে রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি

এ ঘটনায় হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS