১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রাখার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। সেই আসরেই পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার হয়ে অভিষেক হয় ১৬ বছর বয়সী এক ক্রিকেটারের।নাম তার ফ্রাঙ্ক এনসুবুগা।
আইসিসি ট্রফি এখন বিলুপ্ত হয়ে রূপ নিয়েছে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে। এনসুবুগারও পরিচয় বদলেছে। নিজ দেশ উগান্ডার হয়ে খেলছেন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১৬ বছরের সেই কিশোর এখন পরিণত হয়েছেন ৪৩ বছরের ‘বুড়ো’তে। তবে ভারতীয় ক্রীড়ালেখক মতি নন্দীর লেখা বই ‘বুড়ো ঘোড়ার’ মতোই ছুটছেন তিনি। ২৭ বছর ধরে যে স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে খেলা চালিয়ে গেছেন, সেই স্বপ্ন পূরণ হতে আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা তার।
পাঁচ বছর আগেও উগান্ডার কাছে বিশ্বকাপ খেলা ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। কেননা ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগে চতুর্থ বিভাগে নেমে গিয়েছিল তারা। সেখান থেকে রীতিমত এক বিপ্লবই ঘটান কোচ লরেন্স মাহাতলানে ও তার উত্তরসূরি ক্রেইগ উইলিয়ামস। যার ফলে, উগান্ডা এখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মঞ্চে। গত বছর আফ্রিকান বাছাইপর্বে দ্বিতীয় সেরা দল হয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা। হারিয়ে দেয় জিম্বাবুয়ের মতো অভিজ্ঞ দলকে।
উগান্ডান ক্রিকেটের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন খুব কাছ থেকে দেখেছেন এনসুবুগা। শুধু তা-ই নয়, বল হাতে রেখেছেন অনবদ্য অবদানও। সবচেয়ে বেশি বয়সে বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ডও গড়তে যাচ্ছেন বাঁহাতি এই স্পিনার।
২৭ বছরের পরিশ্রমকে সফল হতে দেখে ৫৪ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৫৫ উইকেট নেওয়া এনসুবুগা বলেন, ‘বিশ্বকাপে নাম লেখানোটা ছিল বিস্ময়ের মতো। জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর আবারও খেলতে তর সইছিল না আমাদের। ছেলেরা বেশ রোমাঞ্চিত এবং কী অভিজ্ঞতা হবে সেটা নিতে মুখিয়ে আছে। গত ২৭ বছর ধরে এটার জন্য চেষ্টা করেছি আমি। স্বপ্ন সত্যিই হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম এবং অবশেষে তা হয়েছে। ’
‘আমার বয়স এখন ৪৩, আগস্টে ৪৪-এ পা দেব, তাই আমার জন্য ব্যাপারটা অসাধারণ। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে আর তর সইছে। বিশ্বকাপে উঠতে দেখে বাড়িতে সবাই খুবই রোমাঞ্চিত ছিল। উগান্ডার প্রথম পুরুষ দল হিসেবে এমনটা করতে পেরেছি আমরা এবং সবাই জানতে চায় আমরা কখন খেলব, যাতে করে তারা দেখতে পারে। মানুষ অধীর আগ্রহে বিশ্বকাপের শুরুর জন্য অপেক্ষা করছে, তারাও চোখ রাখবে। ’
বিশ্বকাপে ভালো করার পাশাপাশি নতুন এক প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে এসেছে উগান্ডা। দেশটি ক্রিকেট এখনো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে তা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এনসুবুগা বলেন, ‘বর্তমানে, উগান্ডায় ক্রিকেট অতটা বড় নয়। আমরা খেলাটিকে গ্রামের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি এবং তা ভালোই চলছে, ভবিষ্যতের জন্য কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার রয়েছে আমাদের। ’
‘আমার সময়ে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। আমরা আগে অ্যাস্ট্রোটার্ফ উইকেটে খেলতাম, কিন্তু এখন চারটি ঘাসের উইকেট আছে, যা খুবই ভালো, কারণ আমাদের জন্য অনুশীলন থেকে খেলায় মানিয়ে নেওয়াটা কঠিন ছিল। আমাদের এখন আরও সেমি-প্রফেশনাল সেটা-আপ আছে, যা খুবই ভালো উগান্ডান ক্রিকেটের জন্য। প্রায় পুরোদিনই অনুশীলন করি আমরা এবং আমাদের চুক্তি আছে, তাই বাড়িতে পরিবারের জন্য কিছু (টাকা) নিয়ে যেতে পারি। ’
এনসুবুগার ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় বাবার সূত্র ধরে। কাম্পালায় অবস্থিত লুগোগো ক্রিকেট ওভালে কাজ করতেন তার বাবা। সেই অঞ্চলের ক্লাবগুলোর জন্য দুপুরের খাবার রান্না করতেন তার মা। তবে নিজেকে ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার কৃতিত্বটা তিনি দিয়েছেন পূর্ব আফ্রিকার হয়ে ১৯৭৫ বিশ্বকাপ খেলা স্যামুয়েল ওয়ালুসিম্বিকে।
বাঁহাতি এই স্পিনার বলেন, ‘আমি হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল খেলেছি। টেনিসে খুব ভালো ছিলাম, হ্যান্ডবলও খেলেছি এবং আমি ফুটবলকেও ভালোবাসি। ক্রিকেট শিখেছি সবার শেষে কারণ ক্রিকেট বলের প্রতি ভয় কাজ করত আমরা। আমরা শুরুটা করি টেনিস বল দিয়ে এবং কোচেরা প্রচুর সাহায্য করেছে আমাকে। ’
‘আমার ভাইয়েরা খেলেছে (ক্রিকেট), একজন (রজার মুকাসা) এখনো আমার সঙ্গে জাতীয় দলে খেলছে এবং বাবা আমাদের দেখতে যখন ক্রিকেট মাঠে যেতেন তখন কোচ বলতেন, ওদের প্রতিদিন চারটি সমুচা ও দুটি সোডা খাওয়াবেন। এটাই আমাদের খেলায় রেখেছে এতোদিন। ’
দুই বছর আগে কেনিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এনসুবুগা আরও বলেন, ‘আমি খুবই গর্বিত যে, ৪৩ বছর বয়সে এখনো খেলছি। আমি এখনো শক্তিশালী এবং খুবই কৃতজ্ঞ তার জন্য। আমার একটি রুটিন আছে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি, প্রায় ৬ টার সময় এবং ৭-৮ কিলোমিটার জগিং করি। এরপর ক্লাবে এসে অনুশীলন করি। ’
আগামী ৩ জুন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করবে উগান্ডা। সি গ্রুপে তাদের বাকি প্রতিপক্ষ পাপুয়া নিউগিনি, নিউজিল্যান্ড ও স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখনো পর্যন্ত টেস্ট খেলুড়ে (জিম্বাবুয়ে বাদে) কোনো দেশের বিপক্ষে খেলা হয়নি তাদের। সেই আক্ষেপ মিটতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ দিয়ে।
তাই এনসুবুগার স্বপ্নটাও বড়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার্ড হিটার ব্যাটার আন্দ্রে রাসেলের উইকেটের দিকে তাকিয়ে আছেন বাঁহাতি এই স্পিনার। তার নজরে আছেন কিউই অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনও, ‘আন্দ্রে রাসেলকে বোলিং করতে তর সইছে না আমার এবং কেইন উইলিয়ামসনও অসাধারণ ব্যাটার। যদি তার (রাসেল) উইকেট নিই, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ হব আমি। ’