২০২৩ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সারা বছরই কষ্টে কাটিয়েছে দেশের মানুষ। নির্দিষ্ট আয় দিয়েই সামাল দিতে হয়েছে উচ্চ জীবন যাত্রার ব্যয়।ফলে কখনও কম খেয়ে, কখনও ধার-দেনা করে চলতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে। নতুন বছর এসেছে, নতুন সূর্যও উদিত হয়েছে। দেশের মানুষ তাই পুরনোকে ভুলতে চায়। নতুন উদ্যোগের আশায় বুক বাঁধতে চায় সাধারণ মানুষ, উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা।
গত বছর নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার খরচ বাড়ে। টানা ৯ মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা পরের মাসে বেড়ে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে ওঠে।
ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তারপর আর ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। উচ্চ এই মূল্যস্ফীতি মানুষ দুর্গতি সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে।
নতুন বছরে পুরাতন দুর্ভোগ ভুলে নতুন দিন দেখতে চায় সাধারণ মানুষ। মিরপুর-১০ নম্বরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিরুলের আশা নতুন বছর তার কাছে হবে নব উদ্যোগের। বাড়তি খরচ না করে আয়ের স্রোত দেখতে চান তিনি। নিজ পণ্য বিক্রি করে সংসার ভালো কাটাতে চান। দুই বছর আগে যেভাবে ব্যবসা করেছেন, সেভাবেই আগামী বছরগুলো পার করতে চান তিনি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বিদায়ী বছর নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল পরিবহন শ্রমিক আবুল কালাম আজাদের। আজাদ হোসেনাবাদে ফাতেমা কোচের টিকিট মাস্টার। টিকিট কাউন্টারে বিক্রির পাশাপাশি আয় হয়, এমন টুকটাক কাজও করেন। নতুন বছরে নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে আসবে, আয় দিয়ে ব্যয় সামাল দেওয়া যাবে- এমন আশা করেন তিনি।
সাধারণ জনগণ বলছেন, কয়েক বছর আগেও বাজারে গেলে ৫০০ টাকায় ব্যাগ ভরে পণ্য কিনতে পারতেন তারা। সপ্তাহ পার হলেও বাজারের সমস্যা ছিল না। ২০২৩ সালে একই বাজার করতে অন্তত এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আয় তো বাড়েইনি, সংসারের খরচ টানতে করতে হয়েছে ধার-দেনা। নতুন বছরে এমন কিছু না হোক, আশা এটাই।
নতুন বছর নতুন সরকারের কাছে আজাদের আশা, পুরনো কোনো কিছুই আর চলমান থাকবে না। সরকার দেশের মানুষের চলমান দুর্ভোগ লাঘব করবে। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম যা, তা তো পূরণ হবে না মনে হচ্ছে। পুরনো সরকারই নতুন করে আসবে বলে মনে হচ্ছে। যে-ই আসুক, দেশের উন্নতির পাশাপাশি দলের উন্নতি হোক, জীবনযাত্রার ব্যয় কমুক এটাই চাই।
নতুন বছরে নতুন দিগন্ত দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পুরাতন বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষ কষ্টে ছিল, এটা ঠিক। নতুন বছরে নতুন সরকার আসছে। ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বিগত বছরগুলোর সমস্যার কথা স্বীকার করেছে। বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিকল্পনা গ্রহণের কথাও বলেছে। মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকার ভালো উদ্যোগ নেবে আশা করি।
সরকার সুদ হার ব্যবহার করে মানুষের চাহিদা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করে সরবরাহ ঠিক রাখার কথাও বলেছে। মুদ্রাস্ফীতির শিকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কাজ করবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করে অতি দরিদ্র মানুষকে খাদ্য কর্মসূচির অধীনে নিয়ে আসবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব উদ্যোগ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করলে খাদ্যের মুদ্রাস্ফীতি নাগালের মধ্যে চলে আসবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
নতুন সরকার আসার পর অর্থনীতি-মুদ্রানীতি তথা আর্থিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুদ নীতি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশা করছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি হিসাবে গোলাম রহমান।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ সব উদ্যোগ নিলে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে মুদ্রানীতি একটু সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। সে সময় মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশ বা বার চেয়েও একটু বেশি থাকতে পারে।
কর্মসংস্থান বা আয়-রোজগার যাতে বাড়ে সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারকে সুসম বণ্টনের দিকেও নজর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন ক্যাব প্রধান। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি অতি-লোভস্ফীতিরও জন্ম দেয়, বেশি লাভ করার প্রবণতা তৈরি হয়। নতুন বছরে এটাতেও কিছুটা ভাটা পড়বে।
গোলাম রহমান আরও বলেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে। এটা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডেরই অংশ। ২০২৩ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরসমূহ অনেক চেষ্টা করেছে। সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি যখন বেশি থাকে তখন এটা নিয়ন্ত্রণে প্রধান পদক্ষেপ নিতে হয় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিদায়ী বছরে দুটি প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত থাকতে দেখা গেছে; যথাযথা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নতুন বছরে তারা সেই স্থবিরতা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পাবে।
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাজার সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথাও বলেন ক্যাবের প্রধান। এ জন্য প্রয়োজনে সরকারকেও ব্যবসায় নামার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পণ্য সরবরাহে যদি সরকার ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে কোনো সিন্ডিকেট সুবিধা করতে পারবে না। সাধারণ মানুষের স্বস্তি ফিরবে।
উৎপাদন না বাড়ালে দেশকে খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছিল খোদ সরকার প্রধান। দেশে যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন হয়েছে, আমদানিতেও আপাতত কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। ফলে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতির হার আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখছেন না গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিডিপি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে নিম্ন আয়ে মানুষের জন্য সরকার খাবার পাওয়া সহজ করার কার্যক্রম চালু রেখেছে। এর মাধ্যমে নতুন বছরে নতুন আলো দেখার আশা করছেন তিনি।