গেল বছর মূল্যস্ফীতি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ বাড়িয়ে দেয়। একই সময়ে ছিল ডলার সংকটও।চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারেনি ব্যাংকগুলো। লাগাম টানা হয় আমদানি বাণিজ্যে। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এতে উৎপাদন কমে। অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপের মধ্য দিয়েই এলো নতুন একটি বছর।
নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি কমানো, ডলারের সংকট মোকাবিলা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা কাটানোকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ২০২৪ সাল অর্থনীতির বাঁকবদলের বছর হবে।
সরকারের সফলতার জন্য মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময়হার বাজারমুখী করা, বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দেওয়াসহ ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। মূলকথা হলো দ্রব্যমূল্য, ডলারের রেট নিয়ন্ত্রণসহ আর্থিক খাতে সংস্কারে আরও জোর দিতে হবে। এসবের পাশাপাশি আইএমএফের নির্দেশনা পরিপালন করাও বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়তে শুরু করায় মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমে আসার প্রবণতা নতুন বছরে দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। আর্থিক খাতে সংস্কারের অগ্রগতি পুরনো অস্থিরতাকে পেছনে ফেলে নতুন বছরে অর্থনীতির ক্ষত সারিয়ে তুলে প্রধান সূচকগুলোকে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে। তবে এর সুফল পেতে হলে আর্থিক নীতি-কৌশলে আরও বদল করার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।
কথা হয় অর্থনীতিবিদ ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের সঙ্গে। বাংলানিউজকে বলেন এ বছর আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল ইকোনমিতে (বৈশ্বিক অর্থনীতি) কিছু আশার সঞ্চার দেখছি। ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কিছুটার গতির সঞ্চার হবে। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের যে পরিস্থিতি, তা অন্যান্য কারেন্সির (ডলার) মূল্যের তুলনায় একটু নিচের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হারও কমে এসেছে। সুতরাং গ্লোবাল ইকোনমি যখন কুলডাউন করবে, তখন তার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পরবে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের নির্বাচন নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল, তার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ছিল। এখন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়ে গেলে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আশা করছি।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের যে অর্থনৈতিক নীতিগুলো পুনর্বিন্যাস করা আছে, সেগুলো কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি প্রথমে কিছুটা বেড়ে যাবে। মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করার পদক্ষেপ চলছে। এটি করতে পারলে প্রথমদিকে হয়তো মূল্যস্ফীতির হার আরেকটু বাড়তে পারে, কিন্তু তা সাময়িক। পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা কমে আসবে। বিনিময় হার বাজারমুখী হলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপও কমে আসবে। এটি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। তাই বলা যায় নতুন বছরে বাজারমুখী মুদ্রানীতি ডলার সংকটে সুফল বয়ে নিয়ে আসবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে নির্বাচনের কারণে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্বাচনের পরই সরকার দায়িত্ব নিতে পারবে দ্রুত। যেসব পদক্ষেপ ধীর গতিতে চলছে, তখন সেসবের গতিও বাড়বে। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা তখন বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। এতে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। উৎপাদনশীল কোনো খাতে আমাদের কোনো বিপর্যয় হয়নি। আমরা যদি স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক অর্ডারগুলো ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ হবে বলে আশা করছি।
কিছু চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে জায়েদ বখত বলেন, মুদ্রা বিনিময় হার যখন বাজারমূল্যের কাছাকাছি নিয়ে এলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। সেটি সামাল দিতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি পথ রয়েছে। একটি হলো আমদানিতে কিছু কর প্রত্যাহার করতে হবে। আরেকটি হলো যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, তাদের জন্য ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ করা। মূলকথা হলো দ্রব্যমূল্য ও ডলারের রেট নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। পাশাপাশি আইএমএফের যে নির্দেশনা, তা পরিপালন করা বড় চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অন্যরকম পর্যায়ে রয়েছে। রিজার্ভ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মনিটরিং ব্যবস্থাপনা আরও বাড়াতে হবে। সরকারের সফলতার জন্য মূল্যস্ফীতি কমাতেই হবে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি।
তিনি বলেন, ডলারের দাম ধীরে ধীরে বাড়ানো হচ্ছে, এটি ভালো। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করে ফেলতে হবে। তাহলে প্রবাসী আয় বাড়বে, রপ্তানিকারকরাও তাদের আয় দ্রুত দেশে নিয়ে আসবেন। এ ছাড়া ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে পাওনা টাকা তুলতে হবে। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে।
নির্বাচনের আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে অর্থনীতিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারকে এখন নির্বাচন-পরবর্তী আগামী তিন মাসের জন্য স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায়ও বেশি জোর দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না। আর স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার পাশাপাশি নির্বাচন-পরবর্তী সংস্কারগুলোর বিষয়ে এখনই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সংস্কারের জন্য এখনই তৈরি করতে হবে। শুধু সংস্কারের অঙ্গীকার নয়, নিতে হবে বাস্তব পদক্ষেপ।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক দুটি যুদ্ধ অর্থনীতিতে যে ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা হয়নি। বেড়ে যাওয়া জ্বালানি তেলের দামও কিছুটা কমছে। বর্তমান অবস্থা যদি আরও খারাপ না হয়ে আগামীতে একইভাবে চলে, তাহলেও মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বলতে শুরু করেছে, জ্বালানি তেলের দাম না বাড়লে নীতি সুদহার আর না বাড়িয়ে তা পুনর্বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ নীতি সুদহার কমিয়ে আনবে তারা। তবে সুদহার কমালেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমবে না। কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সুদহার খুব একটা জড়িত নয়। বাজার ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটরা একেক সময়ে একেক পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
সরকারকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির চাপ উত্তরণে বিনিময় হার বাজারমুখী করা ও বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়াতে হবে। নীতিনির্ধারকরা যে কৌশলে চলছেন, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহটা বাড়ছে না, সংকট রয়েই গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে এ ‘ব্যবস্থাপনার মডেল’ না পাল্টানোর পরামর্শ দেন তিনি। তা না হলে, অর্থনীতি আরও খারাপের দিকে না গেলেও ধীর হয়ে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, কোভিড-১৯ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা।
সেই সময়ে মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে দেশে দেশে নীতি সুদহার বাড়ানোর রেশ এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপরও। স্বল্পমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা পড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে। এ কারণে প্রকৃত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে ছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও তা সাড়ে ৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক আগেই থেমে যাবে বলে আইএমএফসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা পূর্বাভাস দিয়েছে।
আইএমএফের এর সবশেষ রিভিউ মিশনের ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে থাকার আরেকটি কারণ হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি দুর্বলতা। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ও নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো সময়োপযোগী ছিল না।