শিল্প কারখানা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন দিতে এখন আর কাজ বন্ধ করে দিনভর বেতন দিতে হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠালে চল যাচ্ছে শ্রমিকে-কর্মচারীর হাতে থাকা মোবাইলে।এতে দিন দিন বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিংয় মাধ্যমে বেতন দেওয়ার হার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ৫০ লাখ ৮৯ হাজার ১০ শ্রমিক-কর্মচারীকে দুই হাজার ৮৮৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। যা আগের বছর ২০২২ সালের অক্টোবরের চেয়ে ১০ লাখ ৯১ হাজার ৭৪ জন বেশি। লেনদেন বেড়েছে ২২৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
২০২২ সালের অক্টোবরে বেতন ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৯৩৬ জনকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছিল দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
শিল্প কারখানাতে বেতন দেওয়া শুরু হলে দিনের অর্ধেক সময় চলে যায়। এর ফলে যেমন সময় ব্যয় হয়, উৎপাদনও ব্যাহত হয়। অন্যদিকে দিন শেষে অফিস-কারখানা থেকে টাকা বহন করলে বাড়তি সমস্যায়ও পড়তে হয়। ভাংতি টাকা নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। কারখানা ও শ্রমিক সূত্রগুলো বলেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়া শুরু হওয়ায় এ সব ঝামেলা দূর হয়েছে। অফিস কারখানা থেকে বেতন দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বেতন শ্রমিক-কর্মচারীর হাতে থাকা মোবাইল ফোনে বেতন-ভাতার টাকার বার্তা পৌঁছে যায়।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেওয়ায় তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন দেওয়া বদলে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক এমএ রহিম ফিরোজ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, হাতে হাতে বেতন দেওয়া হলে দিনে পুরোটা চলে যেতো। তারপর ব্যাংক থেকে টাকা কারখানায় পৌঁছতে তিনচার ঘণ্টা চলে যেতো। একটি গাড়ির পেছনে তিনচার জন মানুষ লাগতো। এ রকম চারটি কারখানা থাকলে বেতনের টাকা পৌঁছাতে চারগুণ লোকবল, যানবাহন লাগতো। যানজটের শহরে এটা একটি কঠিন কাজ। একই সঙ্গে এত গুলো নগদ টাকা বহন করাও সহজ কাজ নয়।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন ভাতা দেওয়া শুরু হওয়ার পর পাঁচ মিনিটে কাজ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক-কর্মচারীর কোন নম্বরে কত টাকা পাঠাতে হবে, টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে কোন মোবাইল ব্যাংকিং অপারেটরে পাঠাবো সেই প্রতিষ্ঠান নাম উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠালেই টাকা চলে যাচ্ছে; জানান এই উদ্যোক্তানেতা।
তিনি বলেন, হাতে বেতন দেওয়ার ফলে অনেক সময় ভাংতি টাকা দেওয়ার সমস্যা হতো। টাকা নিয়ে বাসায় পৌঁছাতে শ্রমিকদের সমস্যা হতো। এখন মোবাইল ফোনে টাকা চলে যাচ্ছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা তার বেতনের টাকা ইচ্ছা মত খরচ করছে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার ফলে শ্রমিকরা অ্যাকাউন্টে রেখে দিচ্ছে। সময় মত তুলে খরচ করছে। এতে সুবিধা হচ্ছে বলে মনে করছেন শ্রমিকরা। এ বিষয়ে মিরপুরের একটি কারখানার শ্রমিক রানী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন দেওয়ার ফলে আমার অযথা খরচ কমেছে। হাতে থাকলে জরুরি দরকার না থাকলে খরচ হতো, এ খরচ কমেছে।
কিছু কিছু মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এটিএম কার্ড ব্যবহারের করার সুযোগ থাকে। বছরে কার্ডের খরচ ৫০০ টাকা। বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কারখানা শ্রমিকদের বেতন মোবাইল ফোনে বেতনের বার্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে এটিএম কার্ড ব্যবহার করে প্রয়োজন মত টাকা তুলে নিচ্ছে। আবার রেখেও দিচ্ছে। কোথাও বেড়াতে গেলে নগদ টাকা বহন না করে এটিএম কার্ড ব্যবহার করছে। বা মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম ব্যবহার করছে। প্রয়োজন মত মোড়ের যে কোন দোকান থেকে টাকা তুলে খরচ করছে।
মোবাইল ফোন গরিবের ব্যাংকিং বলে মনে করছেন এসব গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারীরা। আশুলিয়ার একটি কারখানার শ্রমিক আমিরুল ইসলাম বলেন, আমি তো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করতে পারি না। অ্যাকাউন্ট খুলতে নানা রকম কাগজপত্র চায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এত ঝামেলা নেই। এর মাধ্যমে বেতন পাওয়ার ফলে এটিএম কার্ড ব্যবহার করতে পারছি। অন্য লেনদেনও করতে পারছি।
মার্চেন্ট লেনদেন কার্ড এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পণ্য বা সেবা নিয়ে কার্ডের মাধ্যমে টাকা দেওয়া যাচ্ছে। যদিও এটিএম কার্ড ব্যবহার করে বাজার সদাই করতে পারে, এমন শ্রমিকের সংখ্যায় কম। শ্রমিকরা বেতন পাওয়ার প্রায় পুরোটা চলে যায় ঘরভাড়া, খাদ্য কেনা আর বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে। কিন্তু কিছু শ্রমিক, যাদের বেতন বেশি তারা কিছু কেনাকাটা কার্ডের মাধ্যমেও করে থাকে। দিন দিন এ হার বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মার্চেন্ট পেমেন্টও কম নয়। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। দুই কোটি ৯৬ লাখ ৫৬ হাজার ৮৩৪টি লেনদেনের মাধ্যমে এই পরিমাণ টাকার পণ্য ও সেবা বিনিময় হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। আগের বছরে অক্টোবর মাসে এক কোটি ৬১ লাখ ৭৩ হাজার ৪২৭টি লেনদেনের মাধ্যমে কেনাকাটা হয়েছিল তিন হাজার ৩৫৯ কোট ৯২ লাখ টাকার।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা,ডিসেম্বর ১৯,২০২৩
জেডএ/এমএম