শোক কাটিয়ে ওঠার ফুরসত কোথায় তাঁদের! চোখের সামনে কেবল একের পর এক সন্তানের চলে যাওয়া দেখেছেন তাঁরা। ১৯ দিনের মধ্যে তিন সন্তানকে হারিয়েছেন মিঠুন-আরতি দম্পতি। বড় দুজনের পর আজ বুধবার চলে গেল তাঁদের তৃতীয় মেয়ে হ্যাপি দাস (৬)। হেরে গেলেন বাবা-মা।
হ্যাপির মরদেহ নিয়ে ঢাকা থেকে আজ রাতে চট্টগ্রাম ফিরছেন এই দম্পতি। তাঁদের এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০ জুন। নগরের বান্ডেল রোডের বাসায় আগুনে দগ্ধ হয়েছিল মিঠুনের চার মেয়ে। মূলত তখন থেকেই তাদের বাঁচাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছিল করপোরেশনের এই সেবক (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) দম্পতির।
হ্যাপির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব শেষ হয়। আজ বিকেলে বান্ডেল সেবক কলোনিতে গিয়ে দেখা যায় মিঠুনের মা মালা রানী দাস বিলাপ করছেন, ‘একে একে আমার তিন নাতনিকে নিয়ে গেলে ঠাকুর। আমি কী নিয়ে বাঁচব! কেন এমন শাস্তি দিলে। কীভাবে এত বড় ঘটনা ঘটল।’
গত ২০ জুন ভোরে মিঠুন ও আরতি চার মেয়েকে ঘরে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বান্ডেল রোডের ঘরের ভেতরে একটা বিকট শব্দ হয়। আরতির পাশের বাসায় থাকা ভাই উত্তম দাস বলেন, ‘শব্দ শুনে ঘর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখি। সম্ভবত গ্যাস থেকে আগুন লাগে। পরে আমরা গিয়ে চার মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই। তার মধ্যে ছোট মেয়ে তিন বছরের সুইটি কিছুটা কম দগ্ধ হয়। প্রাথমিক চিকিৎসাতেই সে সুস্থ হয়ে ওঠে।’
দুই দিন পর ২২ জুন দুই মেয়ে সারথী ও হ্যাপিকে ঢাকায় পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। সঙ্গে যান তাদের মা। শুরু থেকেই মেজ মেয়ে ১১ বছরের সাকসির অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুন সকালে মারা যায় সে। সাকসি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। তখন মেয়েকে শেষবারের মতো দেখানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে মা আরতিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হয়। সৎকার শেষে আরতি পুনরায় ঢাকায় অপর দুই মেয়ের কাছে ছুটে যান। সঙ্গে তাদের বাবা মিঠুনও যান। অন্তত এই দুজনকে সুস্থ করে ফিরতে চান তারা। ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তাদের চিকিৎসা চলে। সৃষ্টিকর্তার কাছে কত প্রার্থনা, কত পূজা। তবু ফেরানো যায়নি।
বড় মেয়ে সারথী দাস (১৫) ৩০ জুন না ফেরার দেশে চলে যায়। মেয়ের লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম আসেন দুজন। সৎকার শেষে আবার ফিরে যান ঢাকায়। এবার সব হারিয়ে হ্যাপির প্রাণভিক্ষা চান তাঁরা। আজ সকালে হ্যাপিও চলে যায়।
একের পর এক সন্তান হারানোর শোকে মিঠুন ও আরতি ভেঙে পড়েছেন। ঢাকা থেকে বিকেল পাঁচটায় তাঁরা মেয়ের মরদেহ নিয়ে রওনা হয়েছেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। মুঠোফোনে শববাহী গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছিল। শবযাত্রায় থাকা মিঠুনের ভাই অনিকেষ দাস বলেন, ‘দাদা খুব ভেঙে পড়েছেন। তিনটি মেয়ে চলে গেল চোখের সামনে। কীভাবে ভালো থাকবেন?’
গতকাল মঙ্গলবার অনিকেষ হাসপাতালেই ছিলেন। আইসিইউতে হ্যাপিকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। অনিকেষ বলেন, হ্যাপি কথা বলছিল। তাঁর কাছে জুস ও বিরিয়ানি খাওয়ার আবদার করেছিল। অনিকেষ বলেন, ‘সুস্থ হলে তাকে সব খাওয়াব বলেছিলাম। কিন্তু আজ চলে গেল হ্যাপি। পরিবারটির ‘সুখ’টাই যেন উড়ে চলে গেল আকাশে।’