সদ্য বিদায় নেওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। সে হিসাবে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি—১৫ দশমিক ১২ শতাংশ।
এর মধ্যে গত জুন মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে এত আয় একক কোনো মাসে আসেনি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। তখন করোনার প্রকোপে চলাচল বন্ধের কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। ফলে বৈধ পথে আয় আসা বেড়েছিল।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে সংকটের কারণে ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর দেনা শোধের চাপের কারণে বিদায়ী মাসে তদারকি প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে কিছু ব্যাংক বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনে প্রবাসী আয় এনেছে। এতে প্রবাসী আয় বেড়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে কিছু ব্যাংক।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী আয় বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, এটা অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো খবর। এই ধারা অব্যাহত থাকলে খুবই ভালো হয়। আগামী দু-তিন মাস এই ধারা অব্যাহত থাকলে বোঝা যাবে ডলারের পরিস্থিতি কী হয়। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি চাহিদা কমিয়ে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য। যাতে ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাসে আয় এসেছিল ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার। গত মাসে এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। সে হিসাবে প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২১ সালের জুনে এসেছিল ১৯৪ কোটি ডলার। ২০১৯ ও ২০২০ সালের জুনে এসেছিল যথাক্রমে ১৩৬ কোটি ও ১৮৩ কোটি ডলার।
তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত প্রবাসীরা প্রায় ২০২ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এর পরের কয়েক দিনে তা বেড়ে হয় ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর গত মে মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
প্রবাসী আয়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণত ঈদের আগে দেশে প্রবাসী আয় আসা বাড়ে। ঈদুল আজহা সামনে রেখেই মূলত প্রবাসীরা বাড়তি অর্থ দেশে থাকা তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছে পাঠিয়েছেন। তবে গত এপ্রিলে উদ্যাপিত ঈদুল ফিতরে এবার প্রবাসী আয় খুব বেশি বাড়েনি। সেই তুলনায় ঈদুল আজহা সামনে রেখে প্রবাসী আয় বেশি এসেছে। কারণ, প্রবাসী অনেকেই দেশে কোরবানি দিয়ে থাকেন। আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন সংস্থা কোরবানির জন্য দেশে অর্থ পাঠায়।
প্রবাসী আয় দেশে আনার দিক থেকে বরাবরের মতো এবারও শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে। এরপর প্রবাসী আয় বেশি এনেছে বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দাম দিচ্ছে। এর সঙ্গে সরকার আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। তবে হুন্ডিতে এখনো প্রবাসী আয় ১১২ টাকার বেশি। এ কারণে অনেক প্রবাসী আয় হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। গত জুন মাসে অনেক ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে প্রবাসী আয় কিনেছে। ফলে প্রবাসী আয় সংগ্রহের তালিকায় নতুন কয়েকটি ব্যাংক শীর্ষে চলে এসেছে।
ব্যাংকগুলো এখন রপ্তানি আয়ে ডলারে দাম দিচ্ছে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা। এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে ১০৯ টাকায়। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে ১০৬ টাকায়। আমদানিতে ডলারের দাম পড়ছে প্রায় ১০৯ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র সরোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের সংকট কমে আসছে। প্রবাসী আয় ভালো পরিমাণ আসছে। ব্যাংকগুলোতে ডলারের মজুতও বাড়ছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরের মাস মার্চ থেকেই দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়।
এ দায়িত্ব দেওয়া হয় বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশকে (এবিবি)। এর পর থেকে দুই সংগঠন মিলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে ডলারের দাম। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে সংগঠন দুটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলছে। গত অর্থবছরে বিক্রি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩ হাজার ১১৪ কোটি ডলার। এদিকে ব্যাংকগুলোয়ও ডলারের প্রবাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। আমদানি কমে আসায় ডলারের নতুন চাহিদা কমেছে, তবে আগের আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত জানুয়ারিতে যেসব শর্তে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, তার অন্যতম একটি হলো সব ক্ষেত্রে ডলারের এক দাম নির্ধারণ করতে হবে। সেটা এখনো হয়নি। আগামী সেপ্টেম্বরের পর এই শর্ত পালনের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।