প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য নিয়ে ভাগনার গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন এখন বেলারুশে অবস্থান করছেন। এর অর্থ হলো, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভাগনার সেনাদের পরিচালনায় চুক্তিবদ্ধ হতে অসম্মতি জানিয়েছেন। এ কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কমিটির প্রধান আন্দ্রেই কার্তাপোলভ বলেছেন, ভাগনার সেনারা আর ইউক্রেনে যুদ্ধ করবেন না।
এরই মধ্যে ভাগনার সেনাদের জন্য নতুন একটি ঘাঁটি তৈরির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে বেলারুশ। বেলারুশের রাজধানী থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত শহর অসিপোভিচিতে এই ঘাঁটি নির্মাণের কাজ চলছে।
ভাগনার বিদ্রোহের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরও কিছু দিকে ডালপালা মেলেছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ‘জেনারেল প্রলয়’ নামে পরিচিত সের্গেই সুরোভিকিনকে আটক করা হয়েছে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। রাশিয়ার সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের উপপ্রধান এবং প্রিগোশিন ও ভাগনার গ্রুপের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন সুরোভিকিন। ভাগনার বিদ্রোহ ঠেকাতে তাঁর নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে, এমন খবরই চাউর হয়েছে।
যদিও ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে সুরোভিকিনের মেয়ে তাঁর বাবার আটক হওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, সুরোভিকিন তাঁর কার্যালয়েই আছেন।
পুতিন সরকারের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা হলে, পরিস্থিতি আরও অন্ধকার। রাশিয়ার কিছু মিল ব্লগার (যুদ্ধ-সংক্রান্ত সংবাদ ও ভাষ্য দেন), যাঁরা সাধারণত পুতিন ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেন, তাঁরা বিদ্রোহ যেভাবে মীমাংসা করা হয়েছে, তা নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাঁদের কেউ কেউ ভাগনারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারায় প্রকাশ্যে পুতিন ও সেনাবাহিনীর সমালোচনা করছেন। রাশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এবং পুতিনের প্রতি তাঁদের সমর্থন কতটা টলায়মান, তা বোঝার জন্য সম্ভবত এটাই সেরা মাপকাঠি।
একই সময়ে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ভাগনারের নেতৃত্ব বদল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সেখানকার ভাগনার নেতৃত্বকে অপসারণ করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক প্রত্যুত্তরে জানিয়েছে, ভাগনার গ্রুপের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই মূল্যবান ও অপরিহার্য। কিন্তু এতে কোনো কিছুই বদলাবে না।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে থাকা ভাগনার সেনারা এখন কাদের অধীন থাকবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও মিলছে না। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য যাঁরা দিন গুনছেন, নাকি প্রিগ্রোশিনের সঙ্গে যাঁরা গেছেন তাঁদের সঙ্গে? এই অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতি রাশিয়ার সরকার কীভাবে সামাল দেবে, তার পরিষ্কার কোনো জবাব নেই।
প্রশ্ন হলো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে নিয়োজিত ভাগনার সেনারা কি রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আদেশ মেনে চলবেন? তাঁরা যদি সেটা না মানেন, তাহলে প্রিগোশিনের সঙ্গে তাঁদের আরেকটি সংঘাত আসন্ন। এই সংঘাত রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি এবং বাইরের দেশে তাঁদের নিরাপত্তা পদক্ষেপের ওপর প্রভাব ফেলবে।
ভাগনারের আয়ের বড় অংশটা আসে চরম পর্যায়ের দুর্নীতির মাধ্যমে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে তারা সোনা ও হিরে পাচার করে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাগনার সেনাদের বেতন-ভাতা ও তাদের পরিচালনার খরচ দেওয়ার শর্ত থাকায় প্রিগোশিন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
এসব দুর্নীতির মাধ্যমে প্রিগোশিন সম্ভবত রাশিয়ায় সবচেয়ে ধনী অলিগার্কিতে পরিণত হয়েছেন। বিদ্রোহের পর প্রিগোশিনের ব্যাংক হিসাব, আবাসন ব্যবসা কিংবা অন্যান্য ব্যবসার পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে কেউ কিছু বলেননি। রাশিয়ার সরকার কি প্রিগোশিনের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে?
এই সবকিছু আমাদের দুটি বিকল্প পর্যবেক্ষণের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
প্রথমটি হলো, ক্রেমলিন এখন পর্যন্ত ভাগনারকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী বলে মনে করছে। সে কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে প্রিগোশিন ও তার অনুসারীদের বেলারুশে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত হলো, ক্রেমলিন ভাগনারকে নিজের মতো করে ছেড়ে দেওয়াকে সমাধান মনে করছে। ক্রেমলিনের এই নীতি পুরোপুরি ব্যর্থ হতে চলেছে। প্রিগোশিন ও ভাগনার তাদের খোলনলচে বদলে ফেলার সুযোগ পাচ্ছে। কেননা, রাশিয়ার বাইরে সিরিয়া, লিবিয়া, মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ভাগনার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ পাচ্ছে।
এমন হতে পারে, বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো ভাগনারদের জন্য ঘাঁটি তৈরি করে দিয়ে বিরোধীদের কাছ থেকে তাঁর ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে চান।
বেলারুশের ভিন্নমতাবলম্বীদের পোল্যান্ড সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাঁর সরকারকে রক্ষা করতে পারবে, সম্ভবত এমন ভরসা নিজ দেশের সেনাবাহিনীর ওপর রাখতে পারছেন না লুকাশেঙ্কো। যাহোক, যে বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই বাহিনীর ওপর নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি আছে। যেকোনো সময় হাওয়া উল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে।
পুতিন সরকারের প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করা হলে, পরিস্থিতি আরও অন্ধকার। রাশিয়ার কিছু মিল ব্লগার (যুদ্ধ-সংক্রান্ত সংবাদ ও ভাষ্য দেন), যাঁরা সাধারণত পুতিন ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেন, তাঁরা বিদ্রোহ যেভাবে মীমাংসা করা হয়েছে, তা নিয়ে অসন্তুষ্ট। তাঁদের কেউ কেউ ভাগনারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারায় প্রকাশ্যে পুতিন ও সেনাবাহিনীর সমালোচনা করছেন। রাশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এবং পুতিনের প্রতি তাঁদের সমর্থন কতটা টলায়মান, তা বোঝার জন্য সম্ভবত এটাই সেরা মাপকাঠি।
এই খবরও পাওয়া যাচ্ছে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী, সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের মধ্যে যাঁরা ভাগনারের পৃষ্ঠপোষক, তাঁদের বিরুদ্ধে একটা শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযান কতটা পর্যন্ত গভীর হবে, তা বলার সময় এখনই আসেনি। আবার ইউক্রেনে যখন একটা মরণপণ যুদ্ধ চলছে, সে সময় পুতিন তাঁর সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্ব সরিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি কতটা নেবেন, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না।
রাশিয়ান সাংবাদিক ও ইকো অব মস্কোর সহপ্রতিষ্ঠাতা আলেক্সিই ভেনেডিকটভ জানাচ্ছেন, জেনারেল সুরোভিকিনের সহকারী কর্নেল জেনারেল আন্দ্রেই ইউডিনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে প্রিগোশিন এখন মুক্ত আর সমানভাবে উদ্ধত। পুতিন ও লুকাশেঙ্কোর চুক্তি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।