সংবাদ প্রকাশের জেরে জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি হত্যার ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে পেশাজীবী, মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠন। আজ শুক্রবার বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) আলাদাভাবে বিবৃতি দিয়েছে।
বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন এক বিবৃতিতে বলেন, দ্রুত হত্যাকারী ও নির্দেশদাতাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি নিশ্চিত করতে হবে। একের পর এক কালাকানুন ছাড়াও সাংবাদিক হেনস্তা, নিপীড়ন, খুন, গুম ও হুমকির মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এসব গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার নামান্তর; একই সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রধান অন্তরায়। এর আগে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক হেনস্তা, নিপীড়ন, খুন ও হুমকির বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে করছে সংগঠনটি। বিবৃতিতে গোলাম রব্বানি হত্যার পরিকল্পনাকারী ও ঘাতকদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নিহত সাংবাদিকের পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তার দাবি জানানো হয়েছে।
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে বাড়িতে ফেরার পথে বকশীগঞ্জের পাটহাটি মোড়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সাংবাদিক গোলাম রব্বানি। এ সময় তাঁকে ব্যাপক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ফেলে পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই তাঁকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও অবস্থার অবনতি হলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে গোলাম রব্বানির লাশ বকশীগঞ্জে আনা হয়। এ সময় স্বজন ও এলাকাবাসীর কান্নায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। আজ সকাল ১০টার দিকে বকশীগঞ্জ পৌর শহরের এন এম নূর মোহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর গ্রামের বাড়ি গোমেরচর জিগাতলা মাঠে দ্বিতীয় জানাজার পর তাঁকে দাফন করা হয়।
উপজেলা শহরের গরুহাটি কাছারিপাড়ায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন গোলাম রব্বানি। সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের ভিড়। বাড়ির উঠানে আত্মীয়স্বজনের আহাজারি।
টিআইবি এ ঘটনাকে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হতাশাজনক ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বিবৃতিতে বলেছে, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে সাংবাদিকদের ওপর অবারিতভাবে চলমান হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যা বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষমতার আনুকূল্যে বিচারহীনতা ভোগ করাও স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুর হত্যার সর্বশেষ শিকার গোলাম রব্বানি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের সদিচ্ছার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
টিআইবি বিবৃতিতে আরও বলেছে, সংবাদ প্রকাশের জেরে বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। চেয়ারম্যানের লোকজনই পেশাগত দায়িত্ব পালনের পর ফেরার পথে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছেন গোলাম রব্বানিকে। শুধু তা–ই নয়, গত ১১ এপ্রিল গোলাম রব্বানিকে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতাও মারধর করেছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদে জানা যায়।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জেরে গোলাম রব্বানি হত্যাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায় নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেই সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবান ও তাঁদের যোগসাজশে সাংবাদিকের ওপর হামলা, নির্যাতন, আটক, গুম, এমনকি হত্যা এখন নিয়মিত হয়ে উঠেছে। এ হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধরেরা নিজেদের দুর্নীতি-অন্যায় লুকিয়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। সুষ্ঠু তদন্ত করে এ হত্যায় সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের পাশাপাশি যাঁদের নির্দেশ–যোগসাজশে ও যাঁদের স্বার্থ সুরক্ষায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।’
এমএসএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করা হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতারও পরিপন্থী। সাংবাদিক গোলাম রব্বানির মৃত্যু মারাত্মকভাবে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাংবাদিক গোলাম রব্বানির মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে গ্রেপ্তার করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে।
আরও পড়ুন: যেভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে
নিহত সাংবাদিক রব্বানির মায়ের কান্না থামছে না, বিচার দিলেন জনগণের কাছে
মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দিয়েই সাংবাদিককে পেটানো শুরু করে সন্ত্রাসীরা