ধনকুবের থেকে রাজনীতিবিদ বনে গিয়েছিলেন ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি। অর্থ ও যৌন কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম জড়িয়ে ছিল মোটামুটি সব সময়। তবে ইতালির রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনেও বড় ভূমিকা পালন করেছেন এই ডানপন্থী নেতা।
ইতালির মিলানে জন্ম বেরলুসকোনির। ১৯৩৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিক তরুণ বয়সে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বিক্রি করতেন। একটা সময় গিয়ে নাইট ক্লাবে ও প্রমোদতরিতে গান গাইতেন। গান গেয়ে নামও কামিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিলান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর অবশ্য তাঁর কর্মজীবন বদলে যায়। স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি নির্মাণশিল্পে যোগ দেন। আবাসন ব্যবসা শুরু করেন মিলানজুড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করলে বেরলুসকোনি আসলে এগিয়ে আছেন। কারণ, বেরলুসকোনি নির্মাণশিল্প দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে মিডিয়া মোগলও হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে বেরলুসকোনি কেব্ল-টিভি তেলেমিলানো প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে ইতালির সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এর নাম মিডিয়াসেট। বলা হয়ে থাকে ১৯৭০ ও ’৮০-এর দশকের শেষ দিকে তাঁর গণমাধ্যম ব্যবসা বিস্তৃতি লাভ করে। ইতালির সবচেয়ে বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মনদাদোরি, দৈনিক পত্রিকা ইল জিওরনালের মালিকও হন তিনি।
গণমাধ্যম ব্যবসায় সফল হওয়ার মাঝপথেই বেরলুসকোনি নতুন ব্যবসায় হাত দেন। ১৯৮৬ সালে কিনে নেন ফুটবল ক্লাব এসি মিলান। সেই সময় ক্লাবটিকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি।
বেরলুসকোনি পরিচিত ছিলেন ‘দ্য নাইট’ নামে। ডানপন্থী মতাদর্শের এই ব্যবসায়ী এরপর প্রবেশ করেন রাজনীতিতে। তবে কোনো দলে যোগ দিয়ে নয়। নিজেই গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল। এর নাম দেন ফরজা ইতালিয়া (গো ইতালি)। বলা হয়ে থাকে এর মধ্য দিয়ে ইতালির রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
বেরলুসকোনি ১৯৯৪ সালে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সেই বছরই বাজিমাত করেন। জোট সরকার গঠন করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হন। তবে ডানপন্থী ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ও নর্দান লিগের সঙ্গে করা জোট বেশি দিন টেকেনি। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তাঁর সরকার ভেঙে যায়।
তবে বেরলুসকোনির এই উত্থান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ইতালির রোমের লুইজ স্কুল অব গভর্নমেন্টের পরিচালক জিওভানি ওরসিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে ইতালির নতুন এক ঐতিহাসিক পর্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন বেরলুসকোনি। এই পর্বে দল নয়, একজন ব্যক্তি, একজন শক্তিশালী ব্যক্তির কারণে রাজনীতি নতুন দিশা পায়। তিনি বলেন, ইতালির বাণিজ্যিক টেলিভিশনের যে স্বর্ণ যুগ, সেই যুগের ফসল বেরলুসকোনি।
বেরলুসকোনি প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বেশি দিন টিকে না থাকার অন্যতম কারণ ছিল কেলেঙ্কারি। এ ছাড়া সেই সময় গণমাধ্যমের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিলেন তিনি। এ জন্য বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। তবে এর পরেরবার তিনি নতুন ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ইতালির আর্থিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই প্রতিশ্রুতির কারণে ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি।
বেরলুসকোনি ২০১১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তবে আস্থা ভোটে হেরে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। মূলত যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগে আস্থা ভোটে হেরে যান তিনি।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেশ টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন বেরলুসকোনি। ২০০৯ সালে এক নারী টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, যৌনকর্মী জেনেও তাঁর সঙ্গে রাত্রীযাপন করেছিলেন বেরলুসকোনি। এ ছাড়া ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছরে ৫০ বার আস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে।
ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মোটামুটি বিতর্ককে সঙ্গে নিয়েই চলেছেন বেরলুসকোনি। বারবার ইতালির ট্যাবলয়েড পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক কেলেঙ্কারি, যৌন কেলেঙ্কারি—এসব অভিযোগ বরাবরই উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিচারের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাঁকে।
সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির খবর এসেছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেই সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক মিসরীয় এক যৌনকর্মীর সঙ্গে বেরলুসকোনির সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছড়ায়। সেই সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো নেতার বিচার হবে না—এমন আইনে সমর্থন দিয়েও ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন তিনি।
এসব সমালোচনার কারণে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে বেরলুসকোনির।
তবে এত কেলেঙ্কারির ভিড়ে বেরলুসকোনির আলাদা গুরুত্ব ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফ্রান্সেস্কো গালিয়েত্তি। তাঁর মতে, ২০০০ সালের পর বিভিন্ন পরিস্থিতি তিনি যেভাবে সামলেছেন, তার জন্য বেরলুসকোনিকে মনে রাখতে হবে। গালিয়েত্তি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তিনি একমাত্র ইতালীয় নেতা, যিনি কি না বুঝতেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইতালির অবস্থান কী হবে?