যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার হুমকি নিয়ে রাজনীতিকেরা যতটা আলোচনা ও বাহাস করছেন, ততটা আসল নিষেধাজ্ঞার বেলায় হয়েছে বলে মনে হয় না। নিষেধাজ্ঞাটি যেহেতু ছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং তার কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, সম্ভবত সে কারণেই নিষেধাজ্ঞাকে কোনো দল তাদের পক্ষে নেওয়া পদক্ষেপ হিসেবে দাবি করেনি। কিন্তু ভিসার হুমকিকে ক্ষমতাসীন দল খুব জোরেশোরেই দাবি করছে যে এতে বিরোধী দল বেকায়দায় পড়েছে এবং সরকারের নির্বাচন পরিকল্পনার প্রতি এটি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রকাশের সমতুল্য। বিরোধী দলগুলো, এমনকি সরকারের মনোনীত বিরোধী দলও মনে করে, ভিসার হুমকিতে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলই চাপের মুখে পড়েছে। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের হুমকিকে স্বাগত জানাতে এ ধরনের জাতীয় ঐকমত্য বিরলই বটে!
সব দেশেই ভিসার আবেদন নানা সময় নানা কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়। কাকে নিজেদের দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে বা হবে না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একান্তই সেই দেশের। ২৩ মে যখন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বাংলাদেশে ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের’ লক্ষ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন, তখন উপস্থিত সাংবাদিকেরা বেশ অবাক হন। বারবার তাঁরা প্রশ্ন করতে থাকেন, যেকোনো সময় যেকোনো ভিসা বাতিলের অধিকার যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের আছে, সেহেতু কেন এ রকম আগাম হুমকি দেওয়া? ম্যাথুর উত্তর ছিল একটাই—এটা একটা বার্তা। কার ভিসার আবেদন নাকচ হচ্ছে, তা যেহেতু প্রকাশ করা হবে না, তাহলে এ ঘোষণার গুরুত্ব কী, সে প্রশ্নও তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। তাঁর উত্তর ছিল, এটা যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের নিবৃত্ত করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
ভিসার হুমকিতে ইতিমধ্যে সেই নিবৃত্তির কাজ শুরু হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন। এ যেন গুরুতর অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিক। নজির হিসেবে তাঁরা গাজীপুরে ভোট শান্তিপূর্ণ হওয়া এবং ফল পাল্টানোর আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত সত্য না হওয়ার বিষয়কে উদাহরণ দিচ্ছেন। শুধু ভোটের দিন শান্তি বজায় থাকা এবং আগ্রহীদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারা যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে কথাটি হয়তো সত্য। প্রায় ১০ বছর ভোট দিতে না পারার কারণে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন মানে শুধু ভোটের দিনে ভোট দিতে পারা নয়; বরং নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ, অংশগ্রহণ এবং আচরণবিধি প্রতিপালনও আবশ্যক। গাজীপুরের নির্বাচন শুধু প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বর্জন নয়, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়েও অসম প্রতিযোগিতা ছিল। নির্বাচনের আগে জায়েদা খাতুনের ওপর যতবার হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং তা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী।
অন্য যে চারটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হচ্ছে, সেগুলোও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বর্জনের কারণে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে গণ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুতরাং, সেগুলোয় কমিশনের চ্যালেঞ্জ কার্যত তেমন বড় কিছু নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধাগ্রস্ত করে যেসব কাজ, সেগুলো তখনই প্রকট হয়, যখন তা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে—এমন সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই স্থানীয় সরকার বা সংসদীয় আসনের যে উপনির্বাচন সামনে অনুষ্ঠিত হবে, এগুলোকে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া হিসেবে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে’ সহায়তার কথা বলছে, সেটা কী বা কেমন হতে পারে? ব্যাখ্যাটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে রয়েছে। ওই বিবৃতি অনুযায়ী, যেসব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবে, তার মধ্যে আছে ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য সহিংসতাকে কাজে লাগানো এবং এমন কোনো পদক্ষেপ, যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা সংবাদমাধ্যমকে তাদের মত প্রচার থেকে বিরত রাখা।
ভোট কারচুপি, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথে বাধা সৃষ্টি—এগুলোর প্রতিটির দায় যে সরকারের, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম—এটা বিশ্বাস করলে এ রকম সাবধানবাণীর কোনো প্রয়োজন হতো কি? বিরোধী দলও যে রাজনৈতিক সহিংসতার পথ বেছে নিতে পারে, সে অভিজ্ঞতা আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা তারা পায় না বলে তুলনামূলকভাবে সেই ঝুঁকি অনেকটাই সীমিত।
আমাদের ক্ষমতাসীন দল নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ক্ষোভ চেপে রেখে যতই দাবি করুক না কেন যে বিএনপিই হচ্ছে ভিসার হুমকির লক্ষ্য, দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যম ও বিশ্লেষকেরা মোটেও তা মনে করেন না। প্রতিবেশী ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা একে বাইডেন প্রশাসনের ‘দৃশ্যত আওয়ামী লীগবিরোধী পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
তারা বলেছে, বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রমুখী ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি ঘোষণাতেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকাতেও একই রকম মূল্যায়ন দেখা গেছে। টেলিগ্রাফ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কার্যত এ অঞ্চলে নিজের স্বার্থের ক্ষতি করছে। বিজেপির প্রকাশনা স্বরাজ সাময়িকীতেও লেখা হয়েছে আমেরিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপযুক্ত সময় এটি নয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসব ভাষ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকট প্রতিফলন লক্ষণীয়।
অনেকে অবশ্য ভিসার হুমকির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা নতুন ভিসা নীতি ঘোষিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন অংশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিএনপির কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া ও হামলার সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর নজির তুলে ধরে বলেছেন, সবাই তো আমেরিকা যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না, তাদের সে রকম সাধও নেই। ধানমন্ডি, কেরানীগঞ্জ, বগুড়া, বরগুনা, নাটোর, কুমিল্লা ও কুষ্টিয়ার ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, হয় পুলিশ নয়তো আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা এসব ঘটিয়েছে।
হামলাতেই ঘটনা শেষ হচ্ছে না, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের অফিসে বিএনপির মিছিল থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলই আক্রান্ত হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে। পুলিশ মামলা করছে শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে এবং শত শত অজ্ঞাতনামা আসামি করে। ক্ষমতাসীন দলের ভাষ্যই ফলাও করে বারবার প্রচার করছে সরকারদলীয় সংবাদমাধ্যম। এটি কৌশল হিসেবে বেশ কার্যকর।
বিরোধীদের বড় বড় কর্মসূচি ও নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণহারে আটক করে অজ্ঞাতনামাদের চিহ্নিত করতে পারার দাবি আগেও হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হয়রানির অভিযোগ উঠলে মোক্ষম জবাব হবে; সহিংসতার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিরোধীদের মোকাবিলার কৌশল আগে থেকেই নির্ধারিত থাকা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণেই সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ভিসার হুমকিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। দেশের মর্যাদাহানির কথা তুলতে তাঁরা মোটেও আগ্রহী নন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানোর ব্যাপারে অতি স্পর্শকাতর সরকার ও দলটির এ রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার নেপথ্যে অবশ্য আরও কিছু আছে কি না, বলা মুশকিল।
ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন—এগুলো নাগরিকদের সবারই চাওয়া। ভিসার হুমকিতে তা মিলবে কি না, সে প্রশ্নের চেয়ে তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত মতপ্রকাশ ও সভা-সমিতির অধিকার এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে প্রত্যাশিত নির্বাচন অসম্ভব নয়।