বাফুফের লোগো কি এতই সহজলভ্য?

বাফুফের লোগো কি এতই সহজলভ্য?

লাতিন বাংলা সুপার কাপ নামে ঢাকায় আয়োজিত সাম্প্রতিক ফুটবল প্রতিযোগিতাটি শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আয়োজক বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) নয়, আয়োজন করেছে এএফবি বক্সিং প্রমোশন ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু আয়োজকরা টুর্নামেন্টটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যেন এটি জাতীয় দলের ম্যাচ। 

মাঠে, সম্প্রচারে এবং প্রচারণায় যে অনিয়ম দেখা গেছে, তা শুধু অপেশাদারিত্ব নয়, এগুলো দর্শক বিভ্রান্তি ও জাতীয় ফুটবলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো গুরুতর বিষয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে বাফুফের লোগো ব্যবহার নিয়ে। এটি কি এতটাই সহজলভ্য যে যেকোনো বেসরকারি আয়োজনেও জাতীয় দলের লোগো বসিয়ে দেওয়া যায়?

‘রেড অ্যান্ড গ্রিন ফিউচার স্টার্স’ নামে বাংলাদেশের একটি ক্লাবধর্মী দলকে নামিয়ে টুর্নামেন্টটি প্রচার করা হয়েছে এমনভাবে, যেন বাংলাদেশ বনাম আর্জেন্টিনা বা বাংলাদেশ বনাম ব্রাজিল জাতীয় দল খেলছে। বাস্তবে এটি ছিল তিনটি ক্লাবের বেসরকারি প্রতিযোগিতা। অথচ প্রচারণা ছিল বিভ্রান্তিকর, কখনো সচেতনভাবেই জাতীয় দলের ইমেজ ব্যবহার করে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় ছিল জাতীয় প্রতীকের অপব্যবহার। ম্যাচের দিন মাঠে নামার সময় ‘রেড অ্যান্ড গ্রিন ফিউচার স্টার্স’ দলের জার্সিতে স্পষ্টভাবে বাফুফের লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। দলীয় ছবিতেও হাতে ছিল বাফুফের লোগোসহ প্ল্যাকার্ড, যেন তারা জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। অথচ দলটি জাতীয় দল নয়, এমনকি বাফুফের অনুমোদিত কোনো দলও নয়। একটি বেসরকারি প্রতিযোগিতায় বাফুফের লোগো ব্যবহারের অনুমতি তাদের ছিল না। যা সরাসরি নিয়ম লঙ্ঘন।

আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় হলো, মাঠে বাফুফের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের চোখের সামনে এমন অনিয়ম কিভাবে ঘটল, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই বিষয়ে কথা বলতে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

টিভি সম্প্রচারের সময় বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায়। স্কোরবোর্ডে দুই পাশে দুই দেশের পতাকা-নাম দেখানো হয়। ধারাভাষ্যেও বলা হয় ‘বাংলাদেশ আক্রমণে’, ‘ব্রাজিল বল নিয়ে এগোচ্ছে’, ‘আর্জেন্টিনা চাপ দিচ্ছে’। এতে সাধারণ দর্শক সহজেই ধরে নেন, এটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অথচ মাঠে ছিল তিনটি ক্লাব দল। জাতীয় পতাকা বা দেশের নাম এমনভাবে ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, বিশেষ করে কোনো অননুমোদিত প্রতিযোগিতায়। বাফুফের লোগোও একটি সংরক্ষিত প্রতীক, যার ব্যবহারের রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা।

আয়োজকদের এই বিভ্রান্তিকর আচরণের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা। দ্বিতীয় ম্যাচের পর সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগ বাড়ায়। টি-স্পোর্টসের প্রতিবেদক তার বৈধ পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও মাঠে ঢুকতে বাধা পান, এলিট ফোর্সের সদস্যরা তার গায়ে হাত তোলেন, ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ধরনের ঘটনা দেশের কোনো অনুমোদিত টুর্নামেন্টে দেখা যায় না। দর্শকদের ক্ষেত্রেও ছিল একই বিশৃঙ্খলা; অনেকেই টিকিট কিনেও মাঠে ঢুকতে পারেননি।

অব্যবস্থা, নিরাপত্তাহীনতা ও অনুমোদনবিহীন কার্যক্রমের জেরে শেষ পর্যন্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তৃতীয় ম্যাচ স্থগিত করে এবং স্টেডিয়াম ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করে।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটি প্রদর্শনীমূলক ক্লাব প্রতিযোগিতা নিজেদের ‘আন্তর্জাতিক’ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করে। দর্শককে বিভ্রান্ত করেছে, বাফুফের লোগোকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগিয়েছে এবং ফুটবলের ভাবমূর্তিতে আঘাত দিয়েছে। এটি শুধু অনিয়ম নয়, ফুটবলের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার মতো অপরাধ। বাফুফের লোগো কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রতীক নয়। এর জন্য ফেডারেশনের অনুমতি, দল নির্ধারণ, কিট অনুমোদন ও নথিভুক্ত চুক্তি বাধ্যতামূলক।

প্রশ্নের জবাব তাই স্পষ্ট; বাফুফের লোগো সহজলভ্য নয়, হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা সেই প্রতীককে অপব্যবহারের এক নজির তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় সতর্কবার্তা। সঠিক অনুমোদন প্রক্রিয়া, কঠোর নীতিমালা এবং লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা ছাড়া এমন অনিয়ম বন্ধ হবে না।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS