মারাত্মকভাবে বাড়ছে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন

মারাত্মকভাবে বাড়ছে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন

দেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। এজন্য শক্তিশালী ভোক্তা অধিকার গড়ে তোলা এবং সর্বস্তরে ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের নীতি–কৌশলকে প্রভাবিত করা প্রয়োজন মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, দেশের জনগণ সরকারের কাছে প্রত্যাশা রাখে, কিন্তু সরকারের সক্ষমতা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা হলে জনগণের অধিকার সুরক্ষিত হতে পারে।

শনিবার (০৬ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেটে তুলা উন্নয়ন ভবনে আয়োজিত এক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের ক্রেতা অধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং বাংলাদেশ সেফ অ্যাগ্রো ফুড ইফোর্টস (বিএসএএফই)।

ক্যাবের সভাপতি ও বাংলাদেশ সরকারের সচিব (পি আর এল) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক কাওছারুল ইসলাম সিকদার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোহাম্মদ এনায়েত–ই–রাকিব, বিএসটিআই–এর উপপরিচালক এনামুল হক, কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম, ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া, ক্যাবের ঢাকা জেলা কমিটির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সামস এ খান এবং ক্যাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য শওকত আলী খান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএএফই–এর লিংক পরিচালক মাহমুদ হাসান।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ও ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা এখন জরুরি জাতীয় অগ্রাধিকার। কারণ, প্রতিবছর প্রায় তিন কোটি মানুষ খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বাজারে ভেজাল, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন, অনিরাপদ পণ্য এবং অনলাইন প্রতারণার অভিযোগ বাড়ছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন বেড়েছে, কিন্তু বাজারের ৭১ শতাংশ সবজিতে অতিরিক্ত কীটনাশক, তেলের নমুনায় বিপজ্জনক ট্রান্স–ফ্যাট এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, ডিএনসিআরপিতে গত বছর জমা পড়া ৮০ হাজারের বেশি অভিযোগ থেকে জানা যায়, দেশে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বাড়ছে। এমতাবস্থায় শক্তিশালী ভোক্তা অধিকার গড়ে তোলা এবং সর্বস্তরে ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের নীতি–কৌশলকে প্রভাবিত করা প্রয়োজন। কারণ, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। আর এর জন্য প্রয়োজন সর্বস্তরে প্রযুক্তি ও গবেষণাভিত্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী অংশীদারিত্ব জোরদার করা।

এসময় বক্তারা বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে কী করবেন তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এই খাতে গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরকারকে আরও নিবিড়ভাবে গবেষণা ও উপকরণ সহযোগিতায় ভূমিকা রাখতে হবে।

তারা আরও বলেন, শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক সেমিনার করে ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো। যেহেতু ক্যাবের উপজেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে, তাই তাদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নাগরিকের ক্রেতা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের সেতুবন্ধনের মধ্যে ব্যাপক গ্যাপ রয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে চাপ দিতে হবে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, তাই খাদ্যের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। কিন্তু এই উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে আমরা রাসায়নিক সারের ওপর ঝুঁকে পড়ছি। কৃষকরা রাসায়নিক সারের ওপর এত বেশি নির্ভর হয়ে গেছে যে এখন আর কৃষিপণ্যের উৎপাদনই হচ্ছে না। অর্থাৎ মাটি তার উৎপাদন ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলছে। উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক রাখতে কৃষকদের রাসায়নিক সার বিমুখ করতে হবে এবং জৈব সার নির্ভর করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ক্যাবের সভাপতি এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা সরকার গঠন করবে, তাদের উচিত নাগরিকদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা। কারণ, এটি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম দায়িত্ব। অথচ এসব বিষয়ে কোনো আলোচনা দেখা যাচ্ছে না। তাই নতুন সরকার বা বিরোধী দল যাতে নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করে, সেই বিষয়ে আমাদের সোচ্চার হতে হবে এবং দ্রুত মাঠে নামতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে আপনাদের (বিএসএএফই) সঙ্গে ক্যাব থাকবে। কারণ, ক্যাবের লক্ষ্য ভোক্তার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। ক্যাবের আন্দোলনের ফলেই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর পেয়েছি। অথচ তারা (ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি) এই আলোচনায় নেই, এটি দুঃখজনক। কিন্তু ক্যাব চায় সবাইকে নিয়ে নাগরিকদের ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

সেমিনারে উত্থাপিত মূল ধারণাপত্রে প্রস্তাব করা হয়: সকল অংশীজনের মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব জোরদার করা, খাদ্য বাজারে জবাবদিহি বাড়ানো, ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো, গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন, ডিজিটাল মাধ্যমে অভিযোগ জানানোর সুযোগ বৃদ্ধি ও প্রতিকার পাওয়া সহজ করা।

এছাড়া নিরাপদ খাদ্য নীতিমালা প্রণয়ন, ভোক্তা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সহায়তা এবং টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু–সংবেদনশীল নীতিমালা অনুশীলন করা।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS