আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান বজায় রাখবে আওয়ামী লীগ। রাজপথের আন্দোলনে থাকবে বিএনপিও।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার বিএনপিকে রাজপথে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এত দিন বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা হিসেবে ‘শান্তি সমাবেশ’ করে আসছিল ক্ষমতাসীন দলটি। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সাত–আট মাস বাকি থাকতেই হঠাৎ তারা বিএনপিকে আর কোনো ছাড় না দেওয়ার মতো কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো গতকাল সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ কর্মসূচি’ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল কার্যত বিএনপিকে এই বার্তা দিল, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান বজায় রাখবে তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের সাত–আট মাস আগে ক্ষমতাসীন দল যখন বিরোধী দলকে প্রতিরোধ করার কথা বলতে শুরু করে, তখন রাজনীতিতে মুখোমুখি অবস্থা তৈরি হয়।
এর আগে গত রোববার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, এখন থেকে শান্তি সমাবেশ নয়, সারা দেশে বিএনপিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এ ধরনের অবস্থান নেওয়ার পেছনে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের নামে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। রাজশাহীতে দলটির এক সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের।
বিএনপির একজন নেতা যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখানোটা স্বাভাবিক।
হারুন–অর–রশিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিএনপির রাজশাহী জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবু সাইদের একটি বক্তব্য সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়েছে। তাঁর বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগ কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এরপরই বিএনপিকে প্রতিরোধ করার কথা বলতে শুরু করেছেন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নির্বাচনের সাত–আট মাস আগে ক্ষমতাসীন দল যখন বিরোধী দলকে প্রতিরোধ করার কথা বলতে শুরু করে, তখন রাজনীতিতে মুখোমুখি অবস্থা তৈরি হয়। একইভাবে বিরোধী দলও যখন নিজেদের দাবির বিষয়ে অনমনীয় অবস্থানে চলে যায়, তখন সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। এর কারণ, দুই পক্ষই এখন পর্যন্ত আলোচনার বাইরে গিয়ে রাজপথেই সমাধান খুঁজছে।
আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, তা জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এ ধরনের অবস্থান নিয়ে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে চাইছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপির আচরণের কারণেই তাদের প্রতিরোধ করার কথা বলা হচ্ছে।
একজনের বক্তব্যের জন্য পুরো দলকে দোষারোপ করা হচ্ছে, এটি ঠিক নয়। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে গেলে সংঘাত হতে পারে এবং তা গণতন্ত্র ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
মাহবুবউল্লাহ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থানের বিষয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, জেলা পর্যায়ের একজন নেতার একটি বক্তব্যকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে আওয়ামী লীগ মূলত দমননীতি নিতে যাচ্ছে। এই কাজে তারা প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা রাজশাহীর বিএনপি নেতার বক্তব্যকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাজশাহী বিএনপির ওই নেতা দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। তাঁর বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে।
এর বাইরেও বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের নামে আবার সহিংসতার দিকে যেতে পারে—এমন আলোচনাও রয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে। এ বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছে, এর মাধ্যমে মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে। বিএনপির এমন অবস্থানের অংশ হিসেবেই ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা রাজশাহীর বিএনপি নেতার বক্তব্যকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, রাজশাহী বিএনপির ওই নেতা দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর ওই দুজন সদস্য দাবি করেন, বিএনপি ভেতরে-ভেতরে সহিংসতার পরিকল্পনা করছে, এমন তথ্য তাঁদের কাছে রয়েছে। পাশাপাশি তাঁরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকতে পারে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটেই পশ্চিমা একটি দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ আসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নে সতর্ক থাকতে বলেছে।
তবে হত্যা ও ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকা নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলছে আওয়ামী লীগ, তা কাল্পনিক বলে মনে করেন বিএনপির নেতারা।
‘এক দফার আন্দোলনের কথা বলে বিএনপি আমাদের নেত্রীকে হত্যার বক্তব্য দিচ্ছে। সে কারণে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিরোধ করব আমরা।’
মাহবুব উল আলম হানিফ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
এত দিন বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করে মাঠে থাকলেও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে সেভাবে বাধা দেয়নি। তবে ঢাকার বাইরে বিচ্ছিন্ন কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যখন প্রতিরোধ করার কথা বলা হচ্ছে, তখন বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিএনপিকে প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়ে গতকাল আওয়ামী লীগ তাদের অঙ্গ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম এবং এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মতো সমমনা পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে মাঠে নামিয়েছে। গতকাল সারা দেশে রাজপথে তাদের শোডাউন (শক্তি প্রদর্শন) ছিল বলা যায়।
যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এক দফার আন্দোলনের কথা বলে বিএনপি আমাদের নেত্রীকে হত্যার বক্তব্য দিচ্ছে। সে কারণে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিরোধ করব আমরা।’
বিএনপির প্রতিক্রিয়া ও বিশ্লেষকদের মত
বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ যেসব অভিযোগ তুলেছে, তার কোনোটাই স্বীকার করতে চাননি বিএনপির নেতারা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, সরকার উসকানি দিয়ে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। বিএনপির আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং তা শান্তিপূর্ণভাবেই করা হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও পরিস্থিতিটাকে ব্যাখ্যা করছেন ভিন্ন ভিন্নভাবে। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে যখন প্রতিরোধ করার কথা বলছে, তখন দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক হারুন–অর–রশিদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির একজন নেতা যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখানোটা স্বাভাবিক। এত দিন যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল, তা ব্যাহত হবে এবং মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ বর্তমান পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, একজনের বক্তব্যের জন্য পুরো দলকে দোষারোপ করা হচ্ছে, এটি ঠিক নয়। এমনিতেই বড় দুই দল একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের মধ্যে তিক্ততা আরও বাড়াতে পারে। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে গেলে সংঘাত হতে পারে এবং তা গণতন্ত্র ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।