জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইড) কার্যক্রম কার অধীনে থাকবে, তা নিয়ে সরকার আর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মধ্যে চলছে কয়েক বছরের টানাপোড়েন। একদিকে কমিশন বলছে, স্বাধীন কর্তৃপক্ষ হিসেবে তারাই এই কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষ এবং নাগরিকের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে।অন্যদিকে সরকারও দিচ্ছে নানা যুক্তি। এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে নাগরিকদের সেবা ও তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করায় সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারও বলছে এটি ধীরে ধীরে পৃথক কর্তৃপক্ষের কাছে নেওয়া হবে।
কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বারবার সরকার এনআইডি ইসি থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও ২০২৩ সালে এসে আইন করে বসে। এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনস্ত করার জন্য প্রক্রিয়াও হাতে নেয়। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই উদ্যোগ ইসি কর্মকর্তাদের চাপের মুখে বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের করা আইনটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেও এনআইডি ইসি থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। শুধু তাই নয়, পৃথক কমিশনের কাছে নেওয়ার জন্য অধ্যাদেশের খসড়াও প্রণয়ন করে। এই খবর প্রকাশিত হলে ইসি কর্মকর্তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। গত ৫ মার্চ তারা সরকার ও ইসিকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য ১২ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে কর্মসূচিতে যাওয়ার আল্টিমেটাম দেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকেও অবস্থান বুধবার (১২ মার্চ) পরিষ্কার করা হয়।
সরকার কেন এনআইডি সরিয়ে নিতে চায়
এদিন বিকেলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আগারগাঁওয়ের আইসিটি ভবনে ‘এনআইডির ওনারশিপ’ শীর্ষক এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে যুক্তি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, কমিশনের অধীনে ৩৫ ধরনের তথ্য আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভোটের অধিকার ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্য ৩৫ ধরনের তথ্যের প্রয়োজন আছে কি? এই প্রশ্নটি যৌক্তিকভাবে এবং কারিগরিভাবে উপস্থাপন হয়েছে। আমরা ডেটা অথরিটির কথা বলছি। আমরা বলছি না যে, নির্বাচন কমিশনের যে আইটি সেল আছে সেটাকে বন্ধ করে দেব। তার যে সফটওয়্যার হার্ডওয়্যার এবং কারিগরি ক্ষমতা আছে, সেটাকে আমরা নিয়ে নেব। আমরা যেটা বলছি, ডাটা অথরিটির মাধ্যমে রেগুলেটেড হবে। যার কাছে যেটা আছে সেটা আপাতত সেখানেই থাকবে। ডেটা অথরিটির ধারণাটা বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডকে কমপ্লিমেন্ট করে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমরা চাই সবাই এই বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডটা মেনে নিক এবং এখানে যাতে কোনো ধরনের মিস কনসেপশন তৈরি না হয়। নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েকটা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে; এনআইডি সার্ভার নির্বাচন কমিশনের কাছে থেকে যেন নিয়ে নেওয়া না হয়। আমরা বলতে চাচ্ছি যে, এখন নির্বাচন কমিশন যে ডাটা বেইজ মেইনটেইন করে, তারা সেটাই মেইনটেইন করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের একটি স্বাধীন ডেটা অথরিটির দিকে যেতে হবে। যেটা কিনা আমাদের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অথেন্টিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক, ডেটা এক্সটেন্ট ফ্রেমওয়ার্কের জন্য জরুরি। যার ওপর ভিত্তি করে আমাদের ডিজিটাল অপরচ্যুনিটিগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আইসিটি খাতকে যদি আমরা গার্মেন্টসের আদলে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে প্রতিস্থাপন করতে চাই এবং আমাদের সার্বিকভাবে অর্থনীতির বিকাশ করতে চাই, তাহলে আমাদের এই যাত্রায় যেতেই হবে।
এদিকে এই অবস্থানের প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতোমধ্যে একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এনআইডি ভোটার তালিকার বাই প্রোডাক্ট। এটা তো আগে ছিল না। আগে ভোটার কার্ড ছিল। আস্তে আস্তে যখন ডেভেলপ হলো, তখন এটা হলো। ১৭ বছর ধরে এখানে শ্রম, ঘাম দিয়েছেন এখানকার লোকজন। এরাই তো ডেভেলপ করে এই পর্যন্ত এনেছেন। নিজেদের কাজের অতিরিক্ত কাজ হিসেবে এটা করেছেন। এটা তো একটা নেটওয়ার্ক সারা দেশে ডেভেলপ হয়েছে, এক্সপার্ট ডেভেলপ হয়েছে। সার্বিক এই বিষয়গুলো নিশ্চয়ই সরকার বিবেচনায় নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এরপর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবকে লিখিত আকারে এনআইডি কেন ইসিতে রাখা উচিত সে যুক্তি তুলে ধরেছেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হওয়া
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ‘ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত’ এবং ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ এর ধারা ১১ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী সার্বক্ষণিকভাবে ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালুসহ ভোটার ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এই ডাটাবেজ ব্যবহার করেই নিবন্ধিত ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। ভোটার তালিকা সম্বলিত জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজ অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাও খর্ব করবে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের পূর্বসূত্র এবং বাস্তবতা
২০০৭ সালের আগে ভোটার নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত তথ্য থেকে ভোটার তালিকা হাতে লিখে সম্পাদন করা হতো। ২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং ইউএনডিপির সহায়তায় ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়। ভোটার তালিকার ডাটাবেজটি একটি উন্নতমানের ডাটাবেজে পরিণত হলে এটি বহুবিধ ব্যবহারের সম্ভাবনা বিবেচনা করেই এক পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবাও চালু করা হয়। সূচনালগ্ন থেকে কমিশনের জনবল কার্যত বৃদ্ধি না করেই ১৭ বছর ধরে সেবাটির পরিসর ও মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কমিশন ইতোমধ্যে নিজস্ব জনবলকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলেছে। কমিশনের প্রশিক্ষিত জনবল একাধারে নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম, ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম এবং এনআইডি সেবাদানে সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রকল্প ও রাজস্ব খাতের মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত হাজার লোকবল এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছে একটি সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার।
এদিকে নাগরিকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের একটা সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে, তথা সাধারণ নাগরিক নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত এই সেবার সাথে পরিচিত হয়ে গেছে ও খাপ খাইয়ে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দক্ষ জনশক্তি মেধা, শ্রম এবং ধৈর্যের সাথে এতদিন এই কাজগুলো সম্পাদন করেছে। কাজেই, এটি সরিয়ে নিলে একটি কার্যকরী ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটবে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা
প্রতিটি দেশের ঐতিহাসিক এবং নিজস্ব বাস্তবতার নিরিখে এক একটি সেবা ও তার পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকদের প্রতারণামূলক অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে, দালাল ও অসাধু চক্রের কর্মকাণ্ড রোধে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য নাগরিক তথ্যাদির রক্ষণাবেক্ষণে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তথা নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকায় এক ধরনের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে নাগরিক তথ্য ও জনসেবা সম্পর্কিত কোনো ডাটাবেজই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জাতীয় আস্থা অর্জন করতে পারেনি, যেখানে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকাসহ এনআইডি ডাটাবেজ একটি সফল ব্যতিক্রম।
ভোটার তালিকা ডেটাবেজ থেকে এনআইডি সরালে যে সমস্যা
একই ডাটাবেজের ওপর নির্ভরশীল ভোটার নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম ‘Siamese Twins’ এর মতো। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে ভোটার তালিকা এবং ভোটার তালিকা থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ক্রস চেক করে বিভিন্ন সংশোধন করার পাশাপাশি অপতৎপরতা রোধ করা হয়। এই সেবা দুটি আলাদা করলে নির্বাচন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবাধর্মী কাজে দ্বৈততাসহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেবে।
আর্থিক সংশ্লেষ
জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নির্বাচন কমিশনে থাকায় এবং কমিশনের একই জনবল দ্বারা এই কার্যক্রম সম্পাদনের ফলে দেশ ও সরকারের জন্য এটি একটি সাশ্রয়ী সেবায় পরিণত হয়েছে। এই মুহূর্তে আলাদা কোনো সত্তা তৈরি করলে জনবল, ডিজিটাল পরিকাঠামো, স্থাপনা, প্রশিক্ষণ ও অপরাপর সুবিধাদি তৈরিতে ব্যাপক অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় হবে। একটি কার্যকরী সেবাকে স্থানান্তর না করে এই খরচ পরিহার করা সম্ভব।
একটি কার্যকরী মডেলকে ব্যাহত করা
বাংলাদেশের এই মডেলটি একটি কার্যকরী মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, যা বিভিন্ন দেশে অনুকরণ করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের মডেলটি একটি ‘good practice’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা ও আর্থিক সংশ্লেষ
দেশের অভ্যন্তরের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্যও ‘ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা’ নামে একীভূত সেবা বিদেশে বাংলাদেশের নয়টি মিশনে চালু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন ওই সেবা ৪০টি মিশন অফিসে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা অদূর ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে।
নির্বাচন কমিশনের জনবলের মনোবল ও গর্ব ক্ষুণ্ণ করা
এই সেবা স্থানান্তরের উদ্যোগ ইতোমধ্যে তাদের মনবলে চিড় ধরিয়েছে এবং এক ধরনের অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। উপর্যুপরি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে কমিশন তথা এর জনবলের ভুলুণ্ঠিত ভাবমূর্তি এবং ভেঙে পড়া মনোবল পুনরুদ্ধারে বর্তমান কমিশন সচেতনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির যেকোন নেতিবাচক পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত এবং একটি ভারসাম্য অবস্থাকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি করবে।
গ্রাহকসেবা বৃদ্ধির ক্ষেত্র সম্প্রসারণ
বর্তমানে ১৮২টি সংস্থা নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন বিদ্যামান ডাটাবেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ/যাচাই সেবা নিয়ে থাকে। এই তথ্য সংগ্রহ/যাচাই সেবা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সরাসরি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম, বিবাহ-তালাক সংক্রান্ত তথ্য, শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিতদের প্রাসঙ্গিক তথ্য, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত তথ্যসহ প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য জাতীয় পরিচপত্রের মতো ভোটার তালিকার তথ্যভান্ডারে সংযুক্ত করা সময়ের দাবি।