ভারতে অভ্যন্তরে তিন বিঘা করিডোর ব্যবহার করে বাংলাদেশের দহগ্রাম ইউনিয়নে প্রবেশ করতে হয়। ২২ বর্গকিলোমিটারের ইউনিয়নটিতে ২০ হাজারের মতো বাংলাদেশি নাগরিক বসবাস করেন।
সম্প্রতি সেখানে শূন্যরেখার কাছাকাছি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক কাঁটাতারের বেড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এরপর থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে দহগ্রামের বাসিন্দাদের। কারণ, কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গরু-ছাগল চরাতে, কৃষিকাজ করতে বিএসএফের বাধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাদের।
এছাড়া দহগ্রামে প্রবেশের একমাত্র পথ তিনবিঘা করিডোর দিয়েও যেতে-আসতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তারা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যাতায়াত করছেন তারা। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রামে মালবাহী বড় ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া পর্যটকবাহী বড় বাসও ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
দহগ্রাম সংলগ্ন এলাকায় বিএসএফ এখন কী ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে সে খবর জানতে সরেজমিন দহগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সীমান্তের শূন্যরেখার পিলারের কাছ দিয়ে চার ফুট উচ্চতায় লোহার অ্যাঙ্গেল বসিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে বিএসএফ। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) এই বেড়ায় কাঁটাতারের সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাচের বোতল বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সীমানা বেড়ার পাশ দিয়ে বিএসএফ সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিতেও দেখা গেছে। এছাড়া রাত হলে সীমান্তে নিরাপত্তা এবং নজরদারি বাড়াতে উচ্চ ক্ষমতার লাইট দিয়ে আলোকিত করে রাখে বিএসএফ।
এমন বেড়া দেওয়া, বিএসএফের টহল ও আলোকিত করার কারণে দহগ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ভারত এরকম বেড়া এই প্রথম দিয়েছে জানিয়ে দহগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল হোসেন প্রধান বলেন, কিছু কিছু জায়গায় যেখানে বেশি একটু সমস্যা হয় সেখানে দিত বেড়া। কিন্তু ইদানীং ওরা (বিএসএফ) কোনো জায়গা বাদ দিচ্ছে না। ওরা কাঁটাতারের না ক্যাটেল বেড়া দিচ্ছে এখন, যাতে এদিকের গবাদি পশু ওদের জমিতে না যায়।
বিএসএফ তিন বিঘা করিডোর দিয়ে যাতায়াতে বাধা দিচ্ছে অভিযোগ করে দহগ্রামের বাসিন্দা ফজলুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা যখন পালিয়ে গেলেন তখন থেকে আমরা খুব কষ্টে আছি। এরপর কাঁটাতারের বেড়া দিল। শান্তিভাবে তিনবিঘা করিডোর দিয়ে হাটবাজার করতে পারছি না। এই বেড়া দেওয়ার আগে মহিলা মানুষ ভাত নিয়ে মাঠে যেতে পারছিলেন। এখন এমন হয় যে, আমরা কাজ করছি, ওরা (বিএসএফ) পিটুনি দিচ্ছে তাদের (করিডোর দিয়ে আসা বাংলাদেশি)।
সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশে প্রথম বাড়িটিই ফজলুল ইসলামের। তিনি ৫ আগস্টের আগের ও এর পরের বিএসএফের কড়াকড়ি নজরে এসেছে তার।
তিনি বলেন, ‘দহগ্রাম থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ- বাহিরের জন্য একমাত্র পথ হলো তিনবিঘা করিডোর। চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকলেও ৫ অগাস্টের পর থেকে আগের তুলনায় এই করিডোরে বেশ কড়াকড়ি চলছে। ট্রাক-বাস আসতে দিচ্ছে না বিএসএফ। মনে করেন কলেজের একটা পিকনিক এলো ওইখানে ঢুকতে দেয় না। আমরা বেরুবাড়ি দিয়ে এই তিনবিঘা করিডোর নিয়েছি – এটাতো স্বাধীন হওয়া চাই। ’
সীমান্তের পাশে বাংলাদেশ অংশে চাষাবাদ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, জিরো লাইনে বেড়া দেওয়ার কারণে ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। বিএসএফ টাওয়ার থেকে এসে হুমকি দেয়। যে কারণে ছোটদের ক্ষেতে যেতে দিই না। এখন সন্ধ্যার আগেই ক্ষেত-খামার থেকে বাড়ি ফিরি।
রাতে সীমানাজুড়ে বিএসএফের উচ্চ ক্ষমতার বাতি জ্বালানো নিয়ে আপত্তি দহগ্রামবাসীর। তারা বলছেন, বিএসএফের উচ্চক্ষমতার লাইট তাদের ক্ষেতে পড়ার কারণে ফসলের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
গরু-ছাগল মাঠে আনা-নেওয়াতেও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সমস্যা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান।
ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, ‘আমাদের গরু আমরা আমাদের মাঠে নিয়ে গেলেও বিএসএফ’র বাধার মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় নির্যাতন করে তারা। গরু ভারত থেকে নিয়ে এসেছি বলে বন্দুক তাক করে। গুলি করে দেব বলে ভয় দেখায়। আমাদের গরু কি আমরা ঘরে পুষবো?’
ট্রাক-বাস চলাচলেও অতীতের তুলনায় কড়াকড়ি বেশি জানালেণ দহগ্রাম বাজারের ব্যবসায়ী মো. ওহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বড় কোনো যানবাহন ঢুকতে দিচ্ছে না বিএসএফ। মালপত্র আনতে গেলে অনেক চাপ। মনে করেন একটা বস্তা আনলেও খুব চেকিং চলে। জবাবদিহিতা করতে হয়।
সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে।
এ বিষয়ে ভারতের হাইকমিশনার বলেন, নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়ার বাস্তবায়ন হবে।
এ ইস্যুতে রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক ব্রিফিংয়ে বলেন, শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজ দূরে যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা, দহগ্রামের ক্ষেত্রে শূন্যরেখার উপরে তারা বেড়া দিতে পারবে। লিগ্যালি এইখানে আমাদের বাধা দেওয়ার সুযোগ নাই। কারণ আমরা এটা করতে দিতে সাইন করেছি (২০১০ সালে একটা চুক্তি করা হয়)।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তিনবিঘা করিডোরের ভেতরে যে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ওটা এমন যে চারিদিকে ভারত, আমরা মাঝখানে। এমন সমস্যা আমাদের ট্যাক্টফুলি ইয়ে (হ্যান্ডেল) করতে হয়।
সূত্র: বিবিসি