বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার ধাক্কা দেশেও পড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষের প্রকৃত আয় কমেগেছে। আয় কমে যাওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে কম। যে কারণে অনেকেই সঞ্চয় করতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়ছে ব্যাংক আমানতের ওপর। অনেকে সঞ্চয় থেকেও ভেঙে খাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাই আমানত কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ গ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে। ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের একটি সংগতি থাকতে হয়। যদি আয় বেশি ও খরচ কম হয়—তাহলে বাড়তি অর্থ সঞ্চয় করেন। এখন মানুষের আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে। ফলে সঞ্চয় করতে পারছে না। উলটো ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। এতে একদিকে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সঞ্চয় কমে যাওয়ার কারণে। সঞ্চয় কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এর প্রভাব হতে পারে চক্রাকার। যেমন বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থান কম হবে, মানুষের আয়ও কমবে। নতুন শ্রমশক্তি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ পাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধির হার কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। সরকারি খাতের সঞ্চয়পত্র বিক্রি এখন আর বাড়ছে না। বরং কমে যাচ্ছে। অন্যান্য সঞ্চয়ী উপকরণেও নেতিবাচক অবস্থা। চলতি অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে ৩৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আমানত বাড়ার হার কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া দেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলা ডলার-সংকট পণ্যের আমদানি মূল্য বাড়িয়েছে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য মানুষকে আগের তুলনায় বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেই খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। সঞ্চয়পত্র কেনা বা বিনিয়োগে মানুষের আগ্রহ কমেছে। ফলে তলানিতে ঠেকেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তা দিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করাও সম্ভব হয়নি। বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধেই চলে যাচ্ছে বেশি টাকা। অর্থাৎ কেনার চেয়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ বেশি লক্ষ্য করা গেছে। ফলে সরকারের কোষাগার থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধ করতে হচ্ছে। এদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাও পূরণ হয়নি। এর মধ্যে প্রথম ছয় মাসে এ খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। উলটো সরকার কোষাগার থেকে ৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করেছে। সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
এর আগে করোনার সময়ে ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল। এরপর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত তারল্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। গত জুনের পর থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত। ডিসেম্বর ও জুনে ব্যাংক ক্লোজিংয়ের সময়ে সাধারণত তারল্য বৃদ্ধি পায়। গত ডিসেম্বরে তারল্য বাড়েনি। বরং কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য কমার জন্য ছয়টি কারণকে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে করোনার পর হঠাৎ ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে গ্রাহকদের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এছাড়া আমানত, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার বিষয়টিও চিহ্নিত হয়।
সব মিলে ব্যাংকে যেমন আমানত কমেছে, তেমনি অন্যান্য সঞ্চয়ী উপকরণে বিনিয়োগের প্রবণতা কমে গেছে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অস্থিরতায় মানুষের আয় কমায় ভাটা পড়েছে সঞ্চয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট সঞ্চয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংক খাতে। বাকি ১৮ শতাংশের মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পে ১৪ শতাংশ ও ৪ শতাংশ অন্যান্য খাতে। সঞ্চয়ের প্রধান দুটি উপকরণ ব্যাংক আমানত ও জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প খাতে বিনিয়োগ বেশ কমে গেছে। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রাইজবন্ডসহ অন্যান্য খাতেও সঞ্চয় কমেছে। এর কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত পাঁচ কারণে সঞ্চয় কমেছে। এর মধ্যে ১. দীর্ঘ সময় ধরে চলা অর্থনৈতিক স্থবিরতা, ২. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া, ৩. ডলারের বিপরীতে টাকার মান লাগামহীনভাবে কমে যাওয়া, ৪. মানুষের আয় হ্রাস এবং ৫. জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক আর্থিক-সংকটে বাংলাদেশের কমপক্ষে ৩৭ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। কর্ম হারিয়ে ফেলে নতুন কর্মে যোগ দিতে না পারা, নিয়মিত বেতন-ভাতা না পাওয়া, বেতন-ভাতা কমে যাওয়া, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে মানুষের আয় কমেছে। ছোট সঞ্চয়ের একটি সহজ উপকরণ হচ্ছে প্রাইজবন্ড। এটি যে কোনো ব্যাংক বা সঞ্চয় ব্যুরো কিংবা ডাকঘর থেকে টাকা দিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে কেনা যায়। তিন মাস পরপর লটারির মাধ্যমে এর মুনাফা বাবদ পুরস্কার দেওয়া হয়। এর বিক্রিও সামান্য বাড়লেও এতে সঞ্চয়ের স্থিতি কমে গেছে। গত বছরের ৩০ জুন এ খাতে সঞ্চয়ের স্থিতি ছিল ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ৩১ ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ২১ কোটি ৯০ টাকা। ৩১ জানুয়ারি তা আরও কমে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে এক মাসে কমেছে সাড়ে ৮ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাংকগুলো আমানত হারাচ্ছে। কারণ, এখন মানুষের ব্যাংকে টাকা রেখে বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। বরং জমানো টাকার ওপর ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক পরিশোধের পর যে পরিমাণ মুনাফা হয়, মূল্যস্ফীতি তার থেকে বেশি। ফলে ব্যাংকে আমানত না রেখে নিজেদের কাছে টাকা রেখে খরচ করছেন মানুষ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানতের স্থিতি ছিল প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা কমে ৪৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঐ সময়ে আমানত কমেছে আড়াই শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা ৪১ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছিল। মূল্যস্ফীতির কাছে ব্যাংকের আমানতকারীরা অসহায় এখন। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, আবার ব্যাংকে আমানতের সুদও বেঁধে দিয়েছে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখা আমানতকারীদের কাছে এখন বড় লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিসাবি আমানতকারীরা তাই দ্বিধাগ্রস্ত ও চিন্তায়। তাদের প্রশ্ন, ব্যাংকে টাকা জমিয়ে তাহলে তাদের লাভ কী? ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে এনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (লিজিং) রাখবেন, সে উপায়ও নেই। সেখানে সুদ বেশি পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তখন মূল টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না, সেই আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে মূল টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অনেক গ্রাহক মাসের পর মাস ঘুরছেন।