সাধারণত কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয় সেনাবাহিনীকে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দেশ সম্ভবত পাকিস্তান। যেনো দেশটির সেনাবাহিনীর জন্যই টিকে আছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও তার জনগণ। পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা দেশের জনগণের কাছে থাকলেও কোনো রাজনৈতিক সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কারণ হিসেবে বলা হয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির ক্ষমতায় থাকা সরকারের বিরোধ। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যতোদিন সুসম্পর্ক ততোদিন ক্ষমতায়, বিরোধ শুরু হলে ক্ষমতাচ্যুতি। অথচ দেশটিতে সামরিক শাসন ছিল ১০ বছর। তবে এবারও কী সেই পথেই হাঁটবে পাকিস্তান?
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়েছে। একের পর এক গ্রেপ্তার করা হয়েছে পিটিআই-এর শীর্ষ নেতাদের। দেশজুড়ে শুরু হয়েছে জ্বালাও-পোড়াও। এতে সংকটের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পরপরই একদল বিক্ষোভকারী দেশটির সেনাবাহিনী হেডকোয়ার্টার গেটে হামলা চালায়। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের এমন সহিংস প্রতিবাদ অনেকটা অকল্পনীয়। কেননা এতদিন পর্যন্ত দেশটির টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও সেনাবাহিনী ছিল অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পাকিস্তানের প্রথম গ্রেফতার হওয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কারণ, তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যই নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাকেও কিন্তু গ্রেফতার করা হয়। এরপর ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে করাচির এক সমাবেশে তৎকালীন সামরিক সরকারের নিন্দা করায় বেনজির ভুট্টোকেও গ্রেফতার করা হয় ১৯৮৬ সালের আগস্টে। বেনজির ভুট্টোকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ক্ষমতায় আসীন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ।
এ ছাড়াও নওয়াজ শরীফ ও শাহবাজ শরীফকেও গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয়। মূলত যখন যেই নেতা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখনি সেই নেতাকে গ্রেফতারের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই গ্রেফতার থেকে মুক্তি মিললেও আবারও গ্রেফতার হতে পারেন ইমরান খান।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। ১৯৭৭ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে কারাগারে বন্দি করে জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল হক। অনেকটা বিনা বিচারে ১৯৭৯ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এ ছাড়াও ইউসুফ রাজা গিলানি ও নওয়াজ শরীফও প্রায় ৪ বছর সময়কাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু কোনবারই তারা মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। যেমনটা পারেননি বেনজির ভুট্টো ও বর্তমানে ইমরান খান।
গত কয়েক বছরে পাক রাজনীতির ধাঁচও অনেকটাই বদলে গিয়েছে বলে সে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন। তাদের মতে, পিএমএল (এন) বা পিপিপির মতো পরিবার-নির্ভর পুরনো দলের প্রভাব ক্রমশ কমছে। পাঞ্জাবে উপনির্বাচনের ফল বলছে এই প্রজন্মের তরুণ ভোটারদের কাছে ইমরানের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
যদিও পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, সে দেশে সব সময় জনসমর্থনের ভিত্তিতে ভোটে জেতা যায় না। রাজনীতির উত্থান-পতনের নেপথ্যে বড় ভূমিকা থাকে দেশটির সেনাবাহিনীর। ২০১৮-র পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় পাক সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় সেনার বিরুদ্ধে ইমরানকে ভোটে জেতানোর জন্য কারচুপির অভিযোগও করেছিল পিএমএল (এন) এবং পিপিপি। কিন্তু চার বছরে পরিস্থিতি বদলে গেছে অনেকটা। ইমরান ও তার দলের নেতারা ক্ষমতা হারানোর জন্য দায়ী করেছেন সেনার এক ‘প্রভাবশালী অংশকে’।
ইমরান খান বলেছিলেন, তৎকালীন সেনা প্রধানের নির্দেশক্রমেই তিনি সংসদ ভেঙে দেন। তবে সরাসরি সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগের পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সরাসরি অবস্থান নিতে দেখা যায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে।
২০২১ সালে ইমরান খান যখন ক্ষমতায় তখন পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ ঘিরেই ইমরানের সঙ্গে জেনারেল বাজওয়ার বিরোধের সূত্রপাত। সে সময় আইএসআই প্রধান হিসেবে বাজওয়া-ঘনিষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমের নিয়োগে আপত্তি করেছিলেন ইমরান। বহাল রাখতে চেয়েছিলেন ‘বাজওয়া-বিরোধী’ হিসেবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফৈজ হামিদকে। যদিও সেনার চাপে শেষ পর্যন্ত ইমরানকে মতবদল করতে হয়েছিল।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর এখনও অনেক ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। অনেক সময় দেশটির বিচারব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর মিত্রদের কারণে এই প্রভাব আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে সংকটের সময় বিচার ব্যবস্থা সাধারণত সামরিক কর্মকর্তাদের পক্ষ নেয়।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী অক্টোবরে পাকিস্তানে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এই ঘটোনার পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খান ও তার দলের দুরত্ব আরও বাড়তে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে পাকিস্তানের এখনকার বিভক্তি খুব একটা স্বাভাবিক নয়। পরিণতিও হয়তো ভালো হবে না। এমন ইমরানের অন্যতম কৌশল মানুষের ধর্মীয় মনোভাব কাজে লাগানো, রাজনৈতিক অভিজাতদের প্রতি ঘৃণার বিস্তার ও সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টানা।