কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো ভারতের ধনকুবের গৌতম আদানির সঙ্গে হওয়া বিতর্কিত দুটি বড় চুক্তি বাতিল করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো জোমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংস্কার সংক্রান্ত চুক্তি।
চুক্তির খসড়া প্রস্তাব ফাঁস করে নিজ দেশ কেনিয়ায় নায়ক বনে গেছেন ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্র নেলসন আমেনিয়া। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার সরকারের চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে যারা আন্দোলন করে আসছেন, তাদের কাছে আমেনিয়া এখন নায়ক।
কেনিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিতর্কি হাজারো এমন চুক্তি রয়েছে। দেশটিতে দুর্নীতি রোধে আইন থাকলেও দুর্নীতি থামানোই যাচ্ছে না।
৩০ বছর বয়সী আমেনিয়া ফ্রান্সে এমবিএ করছেন। তিনি গত জুলাইয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি প্রস্তাবিত চুক্তির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তার দাবি, এটি কেনিয়া ও ভারতের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আদানি গোষ্ঠীর মধ্যে একটি প্রস্তাবিত চুক্তির বিস্তারিত।
এ নিয়ে ওই চুক্তিসংশ্লিষ্ট জোমো কেনিয়াট্টা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (জেকেআইএ) কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করে। এই বিমানবন্দর কেনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়। এটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অপেক্ষায় পড়ে আছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারী বলে পরিচিত আমেনিয়া বিবিসিকে বলেন, যখন আমি নথিগুলো পাই, প্রথমে মনে হচ্ছিল এটি অন্যান্য সাধারণ সরকারি চুক্তিই… আমি এর গুরুত্ব বা গভীরতা তখনো বুঝতে পারিনি।
ওই নথিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বিমানবন্দরে আদানি গোষ্ঠীর দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, আদানি ৩০ বছরের জন্য ওই বিমানবন্দর ইজারা নিয়ে নিচ্ছিল।
নথিগুলো পড়তে শুরু করার পর আমেনিয়ার মনে হলো, যদি এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি কেনিয়ার অর্থনীতিতে ক্ষতি করবে, আর এর পুরো লাভ চলে যাবে ভারতের বহুজাতিক ওই কোম্পানির হাতে।
যে তথ্য তিনি পড়েছিলেন, সে অনুযায়ী চুক্তিটি তার কাছে অসন্তোষজনক মনে হয়েছিল। কারণ, এরপরও কেনিয়াকে বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হতো, কিন্তু আর্থিক লাভ তাদের হাতে আসত না।
আমেনিয়া বলেন, এই নথিগুলো আসল বা সত্য হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কারণ, এগুলো এসেছিল সরকারি বিভাগের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোকেদের কাছ থেকে।
আদানি গোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও গ্রিসের মতো দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ, খনি ও বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত।
এর প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি ভারতীয় অর্থনীতির বড় খেলোয়াড়। তার আরেকটি পরিচয়ও রয়েছে। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছের লোক।
চুক্তির খসড়াগুলো পড়ে আমেনিয়া বুঝতে পারেন, ওই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আদানি তার বিনিয়োগ ফিরে না পেলে কেনিয়াকে সেই পরিমাণ অর্থ পরিশোধের দায় নিতে হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রেসিডেন্ট, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের লোকজন, মন্ত্রী জনগণের আস্থার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
তথ্য হাতে থাকা সত্ত্বেও আমেনিয়া পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। তার নিজস্ব নিরাপত্তা হুমকির মুখে ছিল, যদিও ফ্রান্সে থাকায় তিনি কেনিয়ার চেয়ে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিলেন।
তিনি বলেন, আমি একটু ভয়ে ছিলাম। জানতাম না কী হতে চলেছে। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আমি আমার ক্যারিয়ার, আমি আমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি, কেন আমি এ ঝুঁকি নেব?
তবে শেষ পর্যন্ত তিনি অনুভব করেছিলেন যে চুপ থাকাটা সমাধান নয়। তার ভাষ্য, আপনি জানেন, দীর্ঘ দিন বাঁচে শুধুমাত্র কাপুরুষেরা।
সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে পর্যালোচনা করার পর আমেনিয়া জুলাই মাসে তার এক্স পেজে নথিগুলো ফাঁস করেন, যা তৎক্ষণাৎ কেনিয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
বিমানবন্দরের কর্মীরা ধর্মঘটে চলে যান চুক্তিটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে।
তিনি বলেন, এটি আমার জন্য, আমার দেশের জন্য একটি কর্তব্যের মতো মনে হয়েছিল। যদিও আমি দূরে, তবুও আমার দেশের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। আমি চাই কেনিয়া উন্নত হোক, আমার মাতৃভূমি উন্নত হোক, শিল্পায়িত হোক এবং দুর্নীতির অবসান ঘটুক।
এসবেও অবশ্য কেনিয়া সরকার আদানির সঙ্গে চুক্তি থেকে পিছু হটেনি। তবে যখন যুক্তরাষ্ট্র গৌতম আদানিকে আড়াইশ মিলিয়ন ডলার ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত করে, তখন কেনিয়া সরকার চুক্তি বাতিলের পদক্ষেপ নেয়।
গত মাসে পার্লামেন্টে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো এক ভাষণে আদানির সঙ্গে দুটি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়।
রুটো তার ভাষণে বলেন, যদি দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আসে, আমি কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হব না। তার এই বক্তব্যে পার্লামেন্টে উপস্থিত লোকজন চিৎকার করে সমর্থন জানায়।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণা যখন চলছিল, আমেনিয়া তখন ফ্রান্সে বসে ক্লাস করছিলেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি বলেন, আমার মনে হয় অনেকটা সময় আমার চোখ আনন্দে অশ্রুসজল ছিল। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম।
নিজেকে নায়ক ভাবতে রাজি নন আমেনিয়া। সব জায়গা থেকে তিনি সমর্থনের বার্তা পাচ্ছিলেন। এমনকি ভারত থেকেও। ৪০ মিনিট পর ক্লাস শেষে তিনি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেন, আঁদিও আদানি। এর অর্থ হলো- বিদায় আদানি।
কয়েক মাসের ব্যক্তিগত লড়াই ও চাপ শেষে যেন তার বিজয়ের অনুভূতি হচ্ছিল।
বিমানবন্দর সংক্রান্ত চুক্তি ফাঁস করার কিছুদিন পর আমেনিয়াকে মানহানিকর মন্তব্যের জন্য দায়ী করে আদানি গোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি এবং একজন কেনিয়ান রাজনীতিবিদ একটি মামলা করেন। আর সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না, এ নিয়েও ভাবতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকারের কিছু লোক আমার কাছে এসেছিলেন। তারা আমাকে অর্থ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তারা আমাকে বলছিলেন, টাকা নাও, চুপ থাকো, সরকারের সঙ্গে বিরোধ বন্ধ করো।
তিনি আরও বলেন, হাল ছেড়ে দেওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হতো। আর এটি কেনিয়ার জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো।
কিন্তু চুক্তিগুলো বাতিলের পরও প্রেসিডেন্ট রুটো এখনও প্রশ্ন তোলেন, কেন কেনিয়ানরা তার পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা প্রকল্পগুলোর বিরোধিতা করেছে? তিনি জানিয়েছেন, বিমানবন্দর আধুনিকায়নের একটি উপায় তিনি খুঁজে বের করবেন।
প্রেসিডেন্ট রুটো ডিসেম্বরের শুরুতে এক জনসভায় প্রশ্ন তোলেন, আমি দেখেছি, তারা বলছে যে যারা আমাদের বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন থামিয়েছে, তারা নায়ক। নায়ক? নিজের দেশের বিমানবন্দর নির্মাণ থামিয়ে কী লাভ আপনাদের?
তিনি বলেন, আপনারা জানেন না এটি কীভাবে নির্মাণ করতে হবে, আর যারা বিরোধিতা করছেন তারা কখনও বিমানবন্দরের ভেতর পা পর্যন্ত রাখেননি, আপনারা শুধু বিরোধিতা করতে চান।
আমেনিয়া এখনো মানহানি মামলার বিরুদ্ধে লড়ছেন। মামলা চালাতে তিনি তহবিল সংগ্রহ করছেন। তিনি বলছিলেন, কেনিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, আমি কেনিয়ার কিছু গোয়েন্দা সংস্থা এবং ব্যক্তির কাছ থেকে হুমকি পেয়েছি, যারা আমাকে সতর্ক করেছে, আমি যেন দেশে ফিরে না যাই। কারণ, স্পষ্টতই কিছু মানুষ আমার করা কাজ নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ।
এর জন্য চরম মূল্য দিতে হতে পারে, কিন্তু আমেনিয়া আবারও হাসিমুখে তা পরিশোধ করতে রাজি। তিনি বলেন, কেউ আমাদের উদ্ধার করবেন, সত্যিই এমন কারো জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।