‘বেদনা ছাড়া কোনো শিল্প হয় না’। বাংলানিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথাই বলেছিলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ।বলেছিলেন তার কবি হয়ে ওঠার পেছনের বেদনাও। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, শৈশবে মা হারানোর বেদনাই তাকে কবি করে তোলে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে কবির কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘শৈশবেই আপনি মাতৃহারা হয়েছিলেন। এর প্রভাব আপনার কবিতায় পড়েছে কি না?’
জবাবে হেলাল হাফিজ বলেন, ‘মাতৃহীনতার বেদনাই আমাকে কবি করে তুলেছে। মা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র তিন বছর। বোধবুদ্ধি, বিবেচনা তৈরি হয়নি। মাতৃবিয়োগটা সবচেয়ে বড় বেদনা। যে কোনো আত্মীয় মারা যাওয়াটাই বেদনার। তবে মায়ের মতো পরম আত্মীয় আর হয় না। এতো বড় বেদনা! আমার দুঃখ সেখান থেকেই শুরু। দুঃখ, বেদনা কিন্তু শুধু কান্নাকাটির বিষয় না। এটা উপভোগেরও বিষয়, এবং এটা থেকেই শিল্প তৈরি হয়। ভালো ও মৌলিক শিল্প বেদনা থেকেই শুরু হয়। সে বয়সে বুঝতে পারিনি। যত বয়স বেড়েছে, এ বেদনা আমাকে গ্রাস করেছে, আচ্ছন্ন করেছে। মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে কবি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ’
তিনি বলেন, ‘যে কোনো শিল্পের জন্য বেদনা খুবই জরুরি। বেদনা ছাড়া কোনো শিল্প হয় না। ’
তিন বছর বয়সে মাকে হারানোর পর ২৫ বছর বয়সে হারান বাবাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হেলেন নামে এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম করতেন। তার সঙ্গেও বিচ্ছেদ ঘটলে হেলাল হাফিজ ব্যক্তিজীবনে বৈরাগ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। থাকতেন হোটেল হোস্টেল বা হোটেলে।
এই একাকিত্ব জীবনযাপন নিয়ে ওই সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ বলেন, ‘গত ৭-৮ বছর একা একটা হোটেলে থাকি। প্রথম আমি যেদিন সেখানে যাই, সে যে কী আলোড়ন-তোলপাড় আমার ভেতরে। আমি ছাড়া প্রত্যেকে রুমে অপরিচিত মানুষ। পরের সকালে সবাই চলে যাচ্ছে। আমি একা আছি। আবার পরের দিন নতুন বোর্ডার আসছে। প্রথম রাতটি অবর্ণনীয়। একই সঙ্গে বেদনার ও আনন্দের। সে রাতে পঙক্তি লিখেছিলাম। ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো’। এটা লেখার পর বুকের ভারটা, দমবন্ধটা অনেকটা লাঘব হয়েছে। এক ধরনের ভেন্টিলেশন ছিল এই পঙক্তি। ’
জীবনের সায়াহ্নে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মূল্যায়নে কবি বলেন, ‘আমার যোগ্যতা ও প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি অনেক বেশি। এতো বেশি যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ করা যাবে না। একা একা কেঁদেছি, উপভোগও করেছি তেমনি। আমার কোনো অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই। বরং কৃতজ্ঞতা কীভাবে প্রকাশ করবো তা ভেবে পাইনি। এজন্য চুপ থাকা ভালো। নীরবে হয়ে থাকি। এই আর কী!’
নানা আঘাত আর বেদনায় জর্জরিত কবি জীবনের শেষদিকে এসে নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর শাহবাগে তার আবাসস্থলে কবিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।