বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে চোখ হারাতে বসেছেন খুলনার আব্দুল্লাহ শাফিল। তিনি খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটির ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (ইইই) প্রথম বর্ষের ছাত্র।
আহত শাফিল খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে। তার বাবা ইউনুস আলী খোকন গ্রামে মাছের ব্যবসা করেন।
শাফিল ডান চোখে দেখতে পেলেও বাম চোখে মোটেও দেখতে পাচ্ছেন না। গুলিবিদ্ধ হয়ে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না তার পরিবার।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিতে শুক্রবার (২ আগস্ট) খুলনায় আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র-জনতার মুখোমুখি পুলিশ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ রাবার বুলেট-টিয়ারশেলের পাশাপাশি ছররা (শটগান) গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। বন্ধুদের সঙ্গে সেই আন্দোলনে অংশ নেন আব্দুল্লাহ শাফিল। সম্মুখ সারিতেই ছিলেন তিনি। সেদিন বিকেলে হঠাৎ তার চোখের সামনে জ্বলে ওঠে লাল আলো। অন্ধকার হয়ে যায় তার চারপাশ। একাধিক স্প্লিন্টার আঘাত করে চোখ, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে। বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। খুলনা ও ঢাকার একাধিক চক্ষু হাসপাতালে দেখিয়েও লাভ হয়নি তার। গুলি লাগায় বাম চোখ নষ্ট হয়ে গেছে সম্পূর্ণ। চোখে ও মাথায় এখনো স্প্লিন্টার রয়ে যাওয়ায় অপর চোখটিও নষ্ট হওয়ার উপক্রম প্রায়।
শনিবার (১৭ আগস্ট) আব্দুল্লাহ শাফিলের বাসায় তার সঙ্গে হয় বাংলানিউজের।
তিনি বলেন, ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম থেকে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আমি ছিলাম। আমাদের দাবি মানার পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে গুলি ও ভাইদের লাশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নয় দফা থেকে এক দফায় আসি। ২ আগস্ট বিকেলে আমরা নিউমার্কেটে একত্রিত হয়ে শিববাড়ির দিকে যাই। সেখান থেকে নিউমার্কেট হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সোনাডাঙ্গায় যাই। গল্লামারী পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। খুবই শান্তিপূর্ণ। আমরা কোনো পুলিশের গায়ে হাত তুলিনি। লাঠি কিংবা ইট-পাটকেল কিছুই ছিল না। আমরা যখন জিরোপয়েন্ট দিকে যাচ্ছিলাম তখন শুনতে পাই আমাদের এক ভাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করার জন্য সামনের দিকে এগোতে এগোতে শুনতে পাই আমাদের আরও এক ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকি। এ সময় পুলিশের টিয়ারশেল শেষ হয়ে যায়। পুলিশ বৃষ্টির মতো রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছুড়তে থাকে। এগুলো সহ্য করেও আমরা দুই সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাই। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য মাটি কাটার ভেকুর পেছনে লুকিয়ে থাকেন তাকে আমি দেখতে পাইনি। আমি যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাই তিনি আমার মাথা বরাবর গুলি ছোড়েন। এতে আমার মুখে গলায় গুলি লাগে। আমার মাথার মধ্যে দুটি স্প্লিন্টার এখনো গেঁথে আছে। আর একটা স্প্লিন্টার আমার চোখ ছিঁড়ে ভেতরের হাড়ে গেঁথে যায়। চোখের কর্ণিয়া, লেন্স এবং রেটিনা ছিঁড়ে জর্জরিত করে ফেলে। এর কারণে বাম চোখে আমি দেখতে পাই না। এখন ডান চোখও ঘোলা ঘোলা হয়ে গেছে। আমার স্বাধীন বাংলাদেশ আমি আর দুই চোখ ভরে দেখতে পারবো কি না জানা নেই। আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমার মধ্যে আছি।
শাফিল আরও বলেন, ১৫ দিন ধরে সীমাহীন কষ্টে আছি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম সেখান থেকে বলা হয়েছে চোখ অপারেশন করতে দেড় কোটি টাকার মতো লাগবে। বিনা চিকিৎসায় গুলিবিদ্ধ চোখ স্বাভাবিক না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
একমাত্র ছেলের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন শাফিলের মা মাসুমা আক্তার। ছেলের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, আগের মতো চোখের আলো যেন ফিরে পায় শাফিল। ওর অনেক স্বপ্ন আল্লাহ ওকে স্বপ্ন পূরণের তৌফিক দান করুন।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার ছেলের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেন, শাফিলের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তিনি দুই চোখ ভরে উপভোগ করতে পারবেন যদি রাষ্ট্রসহ সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।