বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) হাজার হাজার কোটি টাকার সার গায়েবের ঘটনায় এর সদ্য সাবেক সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনের মালিকানাধীন মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের সার কেলেংকারির সূত্র ধরেই তাকে তলব করে দুদক।
সোমবার (১০ জুন) সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
দুদক সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে।
এর আগে, গত ৩ মে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়- বিএডিসির সাবেক চেয়ারম্যান এ এফ এম হায়াতুল্লাহ ও অমিত সরকার, পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক আব্দুল হালিম ও মো. ইব্রাহীম হোসেন। এসব কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএডিসি সূত্র জানায়, বিএডিসির সদ্য সাবেক সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদ দায়িত্বপালনকালে কয়েকজন পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে একচেটিয়া কমিশন বাণিজ্য করেন। এমনকি সে সময় সরকারি সার আত্মসাতে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্সকে নতুন কাজ পাইয়ে দেওয়া, দেশের অভ্যন্তরীণ সার পরিবহনে পোটন ট্রেডার্স, কুষ্টিয়া ট্রেডিং, বঙ্গ ট্রেডার্স, প্যাসিফিক কনজুমার, স্বদেশ শিপিংসহ বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছ থেকে পারফরমেন্স গ্যারান্টি (পিজি) জামানত না নিয়েই হাজার কোটি টাকার সার পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়া, সময়মতো সার বুঝে না নেওয়া, দেশের কৃষকদের চাহিদা না বুঝে অধিক মূল্যে অপ্রয়োজনীয় সার আমদানি করে ডলার অপচয় করা, সার কালোবাজারির হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার বন্ধ করা হলেও পছন্দের ঠিকাদারকে ব্যবহার করতে দেওয়া, বিল ছাড়ের সময় কমিশন আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল।
একপর্যায়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাকে বদলি করা হলেও তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর না করে বদলি আদেশ বাতিল করানোর জন্য বিভিন্ন মহলে ধরনা দিয়ে তদবির করিয়েছেন। একপর্যায়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাপে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।
অভিযোগ রয়েছে, দেশের কয়েকজন ঠিকাদারের কাছ থেকে তিনি বিরাট অংকের অবৈধ সুবিধা নিয়ে গোটা সার সেক্টরকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এতে ওইসব ঠিকাদাররা সরকারি সার গায়েব করা ছাড়াও পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়া সার এবং বস্তায় ওজনে কম দিয়ে সার গুদামে পাঠায়। গুদাম কর্মকর্তারা তাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই চোখ রাঙানি দিয়ে বিএডিসি চেয়ারম্যান ও সাবেক এমডির সঙ্গে সখ্যতার কথা তুলে ধরে ভয় দেখান ওইসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকজন। কখনো কখনো বাস্তবেও এসব বড় কর্তাদের কর্মকাণ্ডে অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি ফুটে উঠতো। এভাবেই দিনের পর দিন সরকারি সার আত্মসাৎ করে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বিএডিসি।
দুদক সূত্রে জানা যায়, পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) সাবেক সংসদ সদস্য ও সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি। তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার বিরুদ্ধে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএডিসির বিদেশ থেকে আমদানি করা এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের এমপিও, টিএসপি ও ডিএপি-এ তিন ধরনের এক লাখ ৮৪ হাজার ৭১ টন সার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর তিন সদস্যের টিম গঠন করে দুদক। ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার সরবরাহ না করে আত্মসাতের অভিযোগে নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
ওই মামলার আসামিরা হলেন—ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক ও সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান (পোটন), ওই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহাদত হোসেন (নিপু) ও মো. নাজমুল আলম (বাদল), পোটন ট্রেডার্সের উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি সোহরাব হোসেন এবং প্রতিনিধি (খুলনা ও নওয়াপাড়া) মো. আতাউর রহমান।
ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা ২০২১-২২ অর্থবছরে সরবরাহের জন্য বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি করেন। তবে তারা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে চুক্তিকৃত বাফার গুদামে না দিয়ে ৫৮১ কোটি ৫৮ লাখ ৯ হাজার ৬৪ টাকার ৭১ হাজার ৮০১ টন ৩১ কেজি সার আত্মসাৎ করেছেন। কামরুল আশরাফ খানের (পোটন) মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের ৫০ দিনের মধ্যে সার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। সেটা না করে সার ট্রানজিটে রয়েছে বলে বিসিআইসিকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়।