দেশের অন্যতম বিসিক শিল্প নগরী ভালুকা উপজেলার জামিরদিয়া এসকিউ গ্রুপের বিরিকিনা ও সেলসিয়াস কারখানায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে শ্রমিক-কর্মচারীসহ চারজন মৃত্যু হয়। কিন্তু, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ায় বিষয়টি গণমাধ্যমের আড়ালে থেকে যায়।
বিষয়টি সম্পর্কে একটি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পারে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। পরে শ্রমিক-কর্মচারীদের মৃত্যুর ঘটনার নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এসব সংবাদের পর ক্ষতিগ্রস্ত চারটি পরিবারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এসকিউ গ্রুপ।
উল্লেখ্য, গত ১০ জানুয়ারি কারখানায় কর্মরত অবস্থায় শ্বাসকষ্টে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় শ্রমিক নার্গিস আক্তারের। একই কারণে গত ১২ জানুয়ারি রিফাত হাসান ও ১৭ জানুয়ারি শিউলি আক্তারসহ অপর একজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এই তিনদিনে কারখানা দুটির অর্ধশতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। বাংলানিউজের অনুসন্ধানের পর এসকিউ গ্রুপ প্রথমে তাদের তিন শ্রমিক-কর্মচারীর মৃত্যুর কথা জানায়। পরে চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করে প্রতি জনের পরিবারকে পাঁচ লাখ করে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়।
শ্রমিক-কর্মচারী মৃত্যুর ঘটনার পর জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটির দুটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ঘটনাটি তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। পরে কমিটি জানায়, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলা, অবৈধভাবে ইটিপি স্থাপনে ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাসে মিশে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ও অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাগুলো ঘটে। কারখানার ৬ষ্ঠ তলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও এগজস্ট ফ্যান বন্ধ রাখা এবং কারখানার পাশেই ইটিপি স্থাপন করার ফলে সেখান থেকে নির্গত ক্ষতিকারক গ্যাস (মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, এ্যমেনিয়াম) ভেতরে প্রবেশ এবং বায়ু প্রবাহে ত্রুটি থাকায় বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে শ্বাসরোধ হয়ে শ্রমিক কর্মকর্তাসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে অসুস্থ শ্রমিক কর্মচারীদের দায়সারা চিকিৎসা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টিও এই প্রতিবেদনে উঠে আসে।
এরপর গত ৩১ জানুয়ারি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বন্ধ রাখা কারখানা দুটি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এসকিউ গ্রুপের কর্মকর্তা উত্তম দে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কারখানা খোলার পর গত এক মাসের বেশি সময় ধরে আমাদের উৎপাদন কার্যক্রম শতভাগ চালু রয়েছে। আমরা আমাদের চার শ্রমিক-কর্মচারীর পরিবারকে ২০ লাখ টাকা শ্রম আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিয়েছি।
শ্রমিক-কর্মচারী নিহতের ঘটনায় গঠিত সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির সুপারিশ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো সম্ভব হয়নি। পর্যায়ক্রমে করা হবে।
মো. ছাব্বির নামে প্রতিষ্ঠানটির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। তাদের আরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
বাংলানিউজকে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার বাসিন্দা ও এসকিউ গ্রুপের কর্মচারী মৃত রিফাত হাসানের স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া মুক্তা, নেত্রকোনার মদন উপজেলার নিহত শ্রমিক শিউলী আক্তারের স্বামী গোলাম মোস্তুফাসহ অন্যরা।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক আহমেদ মাসুদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে ভেন্টিলেশন সমস্যা সমাধান করে কারখানার ভেতরে বিশুদ্ধ বাতাস বহমান রাখতে ইনপুট ও রিলে ফ্যান স্থাপনের কথা আমরা বলেছিলাম। সেটি করা হয়েছে। তা ছাড়া, কারখানার অন্যান্য নানাদিক সংস্কার করে উপযুক্ত শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের শঙ্কা ও অসন্তোষ বিবেচনায় রেখে ইতোমধ্যে কারখানা দুটি চালু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ প্রায় ৯০ ভাগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হলেও এখনো শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি, পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। আশা করছি এসব বিষয় বিবেচনা করেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কারখানা পরিচালনা করবে।