নদীতে চলাচলকৃত নৌযানের দিক-নির্দেশনার জন্য স্থাপন করা হয় ‘বয়া’। সাধারণত বয়াগুলো পানিতে ভেসে থাকে।কিন্তু লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরভূতা গ্রামের একটি ফসলি জমির মাঝখানে দুটি বয়া পড়ে আছে। শত বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এগুলো। বয়ার নামে গ্রামের একটি অংশের নামও হয়েছে, সেটি হলো ‘বয়ারচর’। এছাড়া স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এই বয়া নিয়ে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বয়া দুটি দেখতে ছুটে যায় ওই ফসলি জমিতে। কীভাবে এবং ঠিক কত বছর দিকে ফসলি মাঠে এ বয়াগুলো এলো, তা নিয়ে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সাথে।
বাংলানিউজকে ওই এলাকার বাসিন্দারা জানান, এক সময় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, তেওয়ারীগঞ্জ, কুশাখালীসহ আশপাশ এলাকা নদী ছিল। তৎকালীন নোয়াখালী জেলার কুশাখালীর ফরাশগঞ্জ ছিল নৌ-বন্দর। শত বছর আগে এ অঞ্চলটি ধীরে ধীরে চর দিয়ে নদী উপজেলার পশ্চিম অংশে সরে যায়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, এ অঞ্চলে যখন নদী ছিল, তখন নদীর নৌযান চলাচলের দিক-নির্দেশনায় যে বয়া স্থাপন করা হয়েছে, এ দুটি বয়া তখনকার সময়ের।
তারা আরও জানান, ফরাশগঞ্জ নৌ বন্দরে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। জাহাজ ভিড়াবার জন্য ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে কয়েকটি বয়া স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে এ দুটি বয়াও ছিল। নদী সরে গিয়ে এলাকায় চর জেগে তখন বয়াগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। তবে কালের বিবর্তনে সেগুলোর ওপর থেকে মাটি সরে গিয়ে ওপরের অংশ দৃশ্যমান হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য জাফর আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, আমার বযস ৪৮ বছর। ছোটবেলা থেকে বয়া দুটি দেখে আসছি। অতীতে বয়ার ওপর লোহার তৈরি খাঁচা ছিল। কিন্তু সেগুলো কেউ হয়তো নিয়ে গেছে। এখন বয়া দুটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।
নারগিস আক্তার নামে এক নারী বলেন, তেওয়ারীগঞ্জের পাশের ইউনিয়ন কুশাখালীতে আমার বাড়ি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বয়াগুলোর ছবি দেখেছি। এখন নিজের চোখে দেখে গেলাম।
সফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বৃদ্ধ বলেন, ১৯৬০ সালের আগে এ চরে তেমন কোনো বসতি ছিল না। নদীর জেগে উঠা চরে ফসল চাষ হত। তখন এ বয়াগুলো লোকজনের নজরে পড়ে। এরপর থেকে বয়াগুলো এভাবেই পড়ে আছে। বয়ার নামে এ এলাকার নাম ‘বয়ারচর’ হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মাইন উদ্দিন পাঠান বলেন, সরকারিভাবে বয়া দুটিকে ওখানেই সংরক্ষণ করা খুবই জরুরি। কেননা এর মধ্যে লুকায়িত আছে আমাদের অতীত ইতিহাস।
বয়া সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নৌ-পথে নৌযান চলাচলে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের দিক-নির্দেশক চিহ্ন স্থাপন করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নির্দেশক চিহ্নগুলোর মধ্যে বয়া প্রাচীন একটি চিহ্ন। নদীতে পণ্যবাহী জাহাজ, ফেরি, লঞ্চ, স্টিমারসহ অন্যান্য নৌযান বিপদ থেকে রক্ষায় বয়া যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বয়ার আকৃতি গোলাকার, যা লোহার তৈরি। একটি লৌহ দণ্ডের সাথে নদী বা নদীর গভীর তলদেশে শিকল ও অ্যাংকর দ্বারা সংযুক্ত করা হয়। ফলে বয়া ওই স্থান থেকে সহজে সরে না। বয়ার পাশাপাশি এখন নদীতে বিকন বাতিও স্থাপন করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের মাস্টার মেরিনার নামক সমুদ্রগামী একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বয়া হলো নেভিগেশন ইকুয়েপমেন্ট। বয়া নদীতে চলাচলকৃত নৌযানকে দিক নির্দেশনা দেয়। এগুলো লোহার তৈরি শিকল ও অ্যাঙ্কর দিয়ে আটকানো থাকে। লক্ষ্মীপুরের একটি চরে থাকা বয়াগুলো শক্তিশালী কোনো ঝূঁর্ণিঝড় বা তীব্র ঢেউয়ের কবলে পড়ে নদী থেকে চরে উঠে এসে থাকতে পারে।