মূল বেদির সামনে আলপনার কাজ প্রায় শেষ। পশ্চিমে জগন্নাথ হলের দিক থেকে আসা রাস্তার দুপাশের দেয়ালে চলছে শেষ মুহূর্তের লেখালেখি আঁকাআঁকির কাজ।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে শহীদ মিনার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
দিবাগত রাত থেকেই শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে ভিড় করবে। প্রতিবারের ন্যায় এবারো শহীদ মিনার এলাকা রাঙানোর কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ মিনারের মূল বেদির সামনে আলপনা এঁকেছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। সেখানে শেষ মুহূর্তের আঁচড় দিচ্ছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। শহীদ মিনারের উত্তর পাশের দেয়ালের প্রতিটি ব্লকে লেখা হয়েছে বিভিন্ন লেখকের কবিতা ও উক্তি।
দেয়ালে লেখা হয়েছে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতার অংশ- ‘এ ভাষারি মান রাখিতে/ হয় যদিবা জীবন দিতে/চার কোটি ভাই রক্ত দিয়ে/ পুরাবে এর মনের আশা। ’
লেখা হয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের উক্তি- ‘মাতৃভাষায় যাহার শ্রদ্ধা নাই, সে মানুষ নহে। ‘ আবুল ফজলের ‘একুশ মানে মাথা নত না করা। ‘
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতার অংশ- ‘মাগো ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না/ বলো মা তাই কি হয়?‘
এর পাশেই আঁকা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের চিত্র। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই‘ স্লোগানরত আন্দোলনকারীদের প্রতিচ্ছবি। ‘উর্দু নয় বাংলা‘, ‘অ আ ক খ‘ প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিলে গলা ফাটানো তরুণ-তরুণীদের ছবি, মৃত কিশোরের লাশ কোলে মায়ের চিত্র।
তবে পুরো দেয়ালচিত্রের কাজ এখনো শেষ হয়নি। শেষ মুহূর্তে তাই ব্যস্ত সময় পার করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।
আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত অতনুর সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তিনি চারুকলা অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আজ বিকেল পাঁচটার মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় প্রাণ খুলে এখানে কাজ করতে আসেন। মাতৃভাষা দিবসে ভাষার নানা অনুষঙ্গ দিয়ে প্রাঙ্গণটি রঙিন করার চেষ্টা করছি আমরা।
রাস্তার অন্য পাশের দেয়ালে লাল রঙে লেখা হয়েছে জাতীয় সংগীতের প্রথম লাইন ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি। ‘ সাথে টেপা পুতুলের আদলে ঘোড়া, মাছ, পাখি, ময়ূর খরগোশ, নৌকাসহ বাংলার নানা চিত্র আঁকা হয়েছে।
আঁকাআঁকির ফাঁকে চারুকলা অনুষদের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সুতপা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের যে কেউ চাইলে এখানে কাজ করতে পারে। শিক্ষকদের নির্দেশনায় সবাই কাজ করে। প্রতিবারের মতো এবারো চারুকলা অনুষদ শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ রঙিন করেছে।
এ বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নেসার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রায় শতাধিক সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী আঁকাআঁকিতে অংশ নিয়েছেন। প্রতিবারের মতো এবারও আমরা কাজ করছি। কাজ বিকেলের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
রঙ করা হচ্ছে রাস্তার পাশের ফুটপাতের ব্লকগুলোও। সাদা কালো রঙে বক্লগুলোতে রঙ করছেন উসমান মিয়াসহ কয়েকজন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তার পুষ্পস্তবক অর্পণের ছবি দিয়ে শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশের প্রবেশমুখে প্রদর্শনী করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে কাজও প্রায় শেষের দিকে।
সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণে উপাচার্য
এদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় শহীদ মিনার প্রস্তুতির সার্বিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তার সঙ্গে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার, একুশে উদযাপন কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব ড. মো. মাকসুদুর রহমান ও চারুকলা অনুষদের ডিন নেসার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
পর্যবেক্ষণ শেষে উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠানটি যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সে উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি। এটি সফলভাবে শেষ করতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে।
তিনি বলেন, আগের বছরগুলোয় আমাদের কোথায় ভুল ছিল, কোথায় গ্যাপ ছিল, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এবার তা কমানোর চেষ্টা করেছি। পুরো অনুষ্ঠান যেন ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হয়, সে ব্যবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বক্তৃতায় বাংলা ভাষার প্রতি অনুরক্ততা প্রকাশ করে যে কথা বলেছিলেন, তার ছবিসহ সে উক্তিও আমরা এখানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছি, যাতে তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস জানতে পারে।
আসছেন দর্শনার্থীরা
এদিন কিছু দর্শনার্থীও শহীদ মিনার দেখতে এসেছেন। শহীদ মিনার দেখতে দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসা থেকে এসেছেন মোহাম্মদ মাহবুব হাসান। তিনি বলেন, ভাষা আমাদের চেতনার অংশ। শহীদ মিনার আগের দিন কেমন হয়, তা দেখতে এসেছি।
শহীদ মিনার দেখতে এসেছে ৯ বছর বয়সী আরিজ রহমান আজান। সে বলে, আম্মু শহীদ মিনার দেখাতে নিয়ে এসেছেন।
রাত ১২টা ১ মিনিটে কার্যক্রম শুরু
একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানাবেন।
এরপর পর্যায়ক্রমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন তিন বাহিনীর প্রধানরা। পরে ভাষা সৈনিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, অনুষদের ডিন ও হলের প্রাধ্যক্ষরা শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত থাকবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যাতায়াতের রুটম্যাপ
একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনের গেট থেকে ফুলার রোড মোড়, টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে বকশীবাজার সড়ক, কাজী মোতাহার হোসেন থেকে শহীদ মিনারের সড়ক এবং দোয়েল চত্বর থেকে চানখারপুল পর্যন্ত সড়ক বন্ধ থাকবে।
জনসাধারণকে পলাশী মোড় হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হলের সামনে দিয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে বলা হয়েছে।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর সেখান থেকে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের সামনের রাস্তা হয়ে দোয়েল চত্বর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে চানখারপুল হয়ে প্রস্থান করা যাবে। শহীদ মিনারের দিকে আসা যাবে না।
এ ছাড়া শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জনসাধারণকে হোম ইকোনোমিকস মোড় দিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের উত্তর গেটের দিকে গিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পর দক্ষিণ গেট দিয়ে ইডেন মোড় হয়ে বের হতে বলা হয়েছে।
চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এ বছর শহীদ মিনারে চার স্তরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শহীদ মিনার এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল টিম, সোয়াত টিম, ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেল টিমমহ অন্যান্য টিম নিরাপদ দূরত্বে প্রস্তুত থাকবে। শহীদ মিনার এলাকায় সার্বক্ষণিক তল্লাশি ব্যবস্থা এবং পেট্রলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ড্রোন পেট্রলিং, মোবাইল পেট্রলিং এবং সাইবার পেট্রলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।