সমুদ্রের জেলিফিশ ক্ষতিকর ও খাওয়ার অনুপযোগী—এতদিন ধরে দেশে এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল। এই প্রথমবারের মতো কক্সবাজার উপকূলে খাওয়ার উপযোগী তিনটি এবং একটি বিষধর জেলিফিশের প্রজাতি শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
গবেষণায় জানা গেছে, লবনেমইডস রোবাস্টাস বা ‘ধলা নুইন্যা/বর নুইন্না’, ‘ক্রেম্বায়োনেলা’ বা ‘বল নুইন্না’ এবং অরেলিয়া অরিটা বা ‘গেলাস নুইন্না’ বঙ্গোপসাগরের এই ৩ প্রজাতির জেলিফিশ খাওয়ার উপযোগী।
গত সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর পেঁচারদ্বীপ উপকূলে জেলেদের জালে আটকা পড়া ২টি জেলিফিশ উদ্ধারের পর প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সেগুলো ঘোস্ট জেলিফিশ বা সায়ানিয়া নোজাকি প্রজাতির বিষধর জেলিফিশ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। যেটি স্থানীয়দের কাছে ‘গরু নুইন্না’ ও ‘হাতি নুইন্না’ নামে পরিচিত।
তবে এই প্রজাতির জেলিফিশ হালকা বিষধর হলেও এর শরীরে মূল্যবান ওষুধি গুণ রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌমিত্র চৌধুরী।
তিনি জানান, গত বছরের আগস্ট থেকে জেলিফিশ নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু হয়। তিনি এবং সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন সিদ্দিক এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। এটি চলমান রয়েছে।
সৌমিত্র চৌধুরী আরও জানান, ঘোস্ট জেলিফিশ বা সায়ানিয়া নোজাকি প্রজাতির জেলিফিশ থেকে কোলাজেন পেপটাইড তৈরি করা হয়। কোলাজেন পেপটাইড ওষুধ, স্বাস্থ্য পণ্য এবং ত্বকের যত্নের প্রসাধনী তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়, যেটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
এটি সাধারণত জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর এবং ইয়েলো সাগরের মতো অঞ্চলে দেখা যায়। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এই প্রজাতি ভারতের উপকূলেও দেখা যাচ্ছে এবং ২০২১ সালে কেরালা উপকূলে ব্লুমের তথ্য পাওয়া যায়, বলেন সৌমিত্র চৌধুরী।
বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো দেখা পাওয়া প্রজাতিটি ব্লুম কিনা, তা নিয়ে গবেষণা চলছে জানিয়ে সৌমিত্র চৌধুরী বলেন, এই প্রজাতিতে বিষাক্ত নেমাটোসিস্ট থাকায় এটি মানুষের জন্য হালকা ঝুঁকিপূর্ণ।
এর সংস্পর্শে ত্বকে জ্বালাপোড়া এবং হূল ফোটানোর মাধ্যমে বেদনাদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে মানুষভেদে এর দংশনের তীব্রতা পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু কিছু মানুষ যারা অ্যালার্জিক, তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান ফুলে যেতে পারে এবং যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের সিস্টেমিক প্রতিক্রিয়াসহ আরও গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
তবে স্থানীয় গবেষক ও সাংবাদিক আহমদ গিয়াসের মতে, ‘গরু নুইন্না’ ও ‘হাতি নুইন্না’ নামে পরিচিত এই জেলিফিশটি দীর্ঘদিন ধরেই কক্সবাজার উপকূলে ধরা পড়ছে। তবে সেটি তেমন বিষধর নয়। বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে বিষধর জেলিফিশ হলো অইনা নুইন্না বা অগ্নি জেলিফিশ। যেটির টেনটাকলের সংস্পর্শে এলে ক্ষতস্থানে পঁচন ধরে এবং শরীরে খুব জ্বালা যন্ত্রণা করে। তবে ক্ষতস্থানে সাথে সাথে সাগরলতা বা ডাউঙ্গা লতার কষ বা ক্ষীর ব্যবহার করলে ব্যথা ও যন্ত্রণা দ্রুত প্রশমিত হয়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে সচরাচর সাগরলতা দেখা যায়।
স্থানীয় জেলেরা জানান, সাগরের বিষধর জেলিফিশগুলো চান্দা মাছের প্রিয় খাদ্য। যেখানে জেলিফিশ বেশি দেখা যায়, সেখানে চান্দা জাতীয় মাছও বেশি পাওয়া যায়।
তিন প্রজাতি খাওয়ার উপযোগী
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌমিত্র চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ভারত ৮০ দশক থেকে এসব জেলিফিশ আহরণ ও রপ্তানি শুরু করেছে।
খাওয়ার উপযোগী যে তিনটি জেলিফিশের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে, এগুলো শুধু কক্সবাজার উপকূল নয়, বঙ্গোপসাগর এমনকি ভারত মহাসাগরে এসব প্রজাতি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
পরীক্ষামূলকভাবে কক্সবাজারেও বিজ্ঞানীরা এই জেলিফিশ দিয়ে স্যুপ তৈরি করেন জানিয়ে সৌমিত্র চৌধুরী বলেন, এগুলো খেতে খুবই সুস্বাদু এমনকি পুষ্টিগুণও রয়েছে। বিভিন্ন দেশে এই প্রজাতির জেলিফিশ দিয়ে স্যুপ, সালাদ, এক ধরনের জেলি এবং নুডলসের সঙ্গে খাওয়া হয়।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশিদ বলেন, জাপানিরা জেলিফিশকে ক্যান্ডিতে রূপান্তরিত করেছে। এক ধরনের মিষ্টি ও নোনতা ক্যারামেল, চিনি, স্টার্চ সিরাপ এবং জেলিফিশ পাউডার দিয়ে তৈরি করা হয় সেই ক্যান্ডি, যা বেশ ব্যয়বহুল এবং সুস্বাদুও বটে। এছাড়াও সালাদে, নুডলসে এবং সয়া সস দিয়ে প্রায়শই এদের খাওয়া হয়। থাইল্যান্ড জেলিফিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ ছাড়াও কোলাজেনের উৎস হিসেবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, ঔষধ শিল্পে এবং বিশ্বজুড়ে পাবলিক একুরিয়ামে জেলিফিশ প্রদর্শিত হয়।
ড. তৌহিদা রশিদ আরও বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে। এরমধ্যে ১২ প্রজাতির জেলিফিশ খাওয়ার উপযোগী। আর আমাদের বঙ্গোপসাগরেও অন্তত ৩ প্রজাতির খাওয়ার উপযোগী জেলিফিশ পাওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য প্রজাতির জেলিফিশগুলোতেও রয়েছে মূল্যবান ওষুধি গুণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে এক কেজি জেলিফিশের দাম ১০ ডলার বা প্রায় ১১০০ টাকা। বিশ্বে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে জেলিফিশের। আর সেই জেলিফিশ এখন কক্সবাজার সৈকতের পোকা-মাকড়ের খাদ্য, বলেন ড. তৌহিদা।
এই জেলিফিশ সুনীল অর্থনীতিতে ও নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে জেলিফিশ থেকে তৈরি হচ্ছে সার, কীটনাশক, ওষুধ ও কসমেটিক্সসহ নানা পণ্য। এশিয়ার কিছু অঞ্চলে, জেলিফিশ হাড় ও পেশীর ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।