বাংলাদেশে এবার রোজার ঈদের কয়েকদিন আগেই ঈদের তারিখ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
২১শে এপ্রিল অর্থাৎ শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে চাঁদ দেখা যাবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এ বিজ্ঞপ্তি বুধবার প্রকাশিত হবার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন দৃশ্যত আপত্তি তুলেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আবহাওয়া অধিদপ্তর তাদের বিজ্ঞপ্তি সেটি সরিয়ে নেয়। এর পরদিন বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির জবাবে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে কোন দেশে কখন নতুন চাঁদ দেখা যাবে তা আগে থেকেই হিসেব করে বলে দেয়া সম্ভব। তাহলে এখনো কেন চাঁদ দেখা নিয়ে এরকম মতপার্থক্যের ঘটনা ঘটছে?
আবহাওয়া অধিদপ্তর বাংলাদেশ থেকে চাঁদ দেখা যাবে বলে তাদের প্রকাশিত ঐ বিজ্ঞপ্তিতে চাঁদের স্থানাঙ্ক প্রকাশ করে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর অবশ্য কিছুক্ষণ পরই তাদের এই বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আগের বিজ্ঞপ্তিতে ‘চাঁদ দেখা যাবে’ লেখা থাকলেও তা পরিবর্তন করে ‘আকাশ মেঘমুক্ত থাকার সাপেক্ষে চাঁদ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে’ লেখা হয়।
এর পরদিন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে ঈদের চাঁদ দেখা সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য প্রদান করার এখতিয়ার শুধু জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির রয়েছে।
ঐ বিজ্ঞপ্তিতে চাঁদ দেখা নিয়ে ‘অগ্রিম, বিভান্তিকর ও এখতিয়ার বহির্ভূত’ সংবাদ প্রকাশে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে অনুরোধ করা হয়।
একুশে এপ্রিল সন্ধ্যায় জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভা শেষে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ঈদ-উল-ফিতরের চূড়ান্ত ঘোষণা দেবেন বলে জানানো হয় ঐ বিজ্ঞপ্তিতে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সাধারণত প্রতি মাসেই তাদের ওয়েবসাইটে চাঁদের স্থানাঙ্ক জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। তবে শাওয়াল মাসের চাঁদের সাথে রোজার ঈদের সম্পর্ক থাকায় সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিটি নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়।
মুসলিমদের জন্য পবিত্র হিসেবে বিবেচিত রমজান মাসের শেষ হয় শাওয়াল মাসের এক তারিখ ঈদ-উল-ফিতর বা রোজার ঈদ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। আর এই তারিখটি নির্ধারিত হয় নতুন চাঁদ দেখার ওপর।
মুসলমানরা যে হিজরি সাল ব্যবহার করে, তা চন্দ্র বর্ষপঞ্জী নির্ভর। তাই চাঁদ দেখা যাওয়ার সাথেই নির্ধারিত হয় মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবগুলো।
এ বছর সৌর ক্যালেন্ডারের যে দিনে চান্দ্র বছর শুরু হয়, পরের বছর তার ১১ দিন আগে শুরু হবে পরবর্তী চান্দ্র বছর। অর্থাৎ সৌর ক্যালেন্ডারের হিসেবে আগামী বছরের ঈদ এই বছরের ঈদের চেয়ে এগারো দিন আগে হবে।
চান্দ্র বছর অনুসরণ করার মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলিম ভিন্ন মৌসুমে রোজা রাখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। একজন মুসলিম যদি তার জীবনের ৩৩ বছর ধরে রমজান মাসে রোজা রাখেন, তাহলে সৌর ক্যালেন্ডারের সবগুলো মাসে এবং সব ঋতুতে রোজা পাবেন তিনি।
চাঁদ কবে কোন অবস্থানে থাকবে, আধুনিক প্রযুক্তি অনুযায়ী তা পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে আগে থেকে বলে দেয়া সম্ভব। কিন্তু তারপরও সারাবিশ্বেই মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব পালনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হয় খালি চোখে চাঁদ দেখাকে।
বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, হাদীস অনুযায়ীই খালি চোখে চাঁদ দেখাকে প্রাধান্য দেয়া হয় ধর্মীয় উৎসব নির্ধারনের ক্ষেত্রে।
“নিজের চোখে দেখে রোজা রাখা শুরু করা এবং ঈদ উদযাপন করার উপদেশ দেয়ার স্পষ্ট হাদীস রয়েছে। আরও বলা হয়েছে কোনো কারণে চাঁদ দেখা না গেলে – অর্থাৎ চাঁদ উঠলো কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় দেখা গেলো না – ত্রিশ দিন মিলিয়ে ঈদ পালন করতে।”
“এ কারণেই সারা বিশ্বের মুসলিমরা ঈদ পালনের ক্ষেত্রে নিজ চোখে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে থাকে”, বলেন মোহাম্মদ রুহুল আমীন।
প্রতি বছরই মুসলিম দেশগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদ পালন করে থাকে। যেমন এ বছরও কোনো দেশ ঈদ পালন করছে ২১শে এপ্রিল, আবার কোনো দেশে তা পালিত হচ্ছে ২২শে এপ্রিল।
সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২১শে এপ্রিল ঈদ হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ওমানে ঈদ পালন করা হবে ২২শে এপ্রিল।
আবার সিঙ্গাপুর বা ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ শুক্রবার হলেও মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপানে ঈদ পালন করবে শনিবার।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ঈদের তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ঈদ পালন হবে শনিবার। আবার পাকিস্তানে ঈদ পালিত হচ্ছে শুক্রবার।
কোন দিন ঈদ পালন করা হবে, সেই সিদ্ধান্তটাও একেক দেশে একেকভাবে নেয়া হয়ে থাকে।
সৌদি আরবে সাধারণ মানুষ চাঁদ দেখার খবর জানালেই কর্তৃপক্ষ ঈদ পালন করার সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। অনেক মুসলিম দেশই সৌদি আরবের সিদ্ধান্তের দেখাদেখি তাদের নিজেদের দেশের ঈদের সিদ্ধান্ত জানায়।
অন্যদিকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানে চাঁদ দেখার পর সরকারি ঘোষণা আসার প্রেক্ষিতে ঈদ হয়ে থাকে।
ইরাকের শিয়া মতাবলম্বীরা ঈদের সিদ্ধান্ত জানতে অপেক্ষা করেন তাদের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লাহ-আলী-সিস্তানির ঘোষণার জন্য, আর সুন্নিরা অপেক্ষা করেন তাদের প্রধান নেতার ঘোষণার জন্য।
অন্যদিকে তুরস্ক রমজান মাসের শুরু এবং শেষ কবে হবে তা নির্ধারণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনা অনুযায়ী।
২০১৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল তুরস্কের উদ্যোগে।
সেখানে তুরস্ক, কাতার, জর্ডান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরোক্কো সহ ৫০টি দেশের ধর্মীয় পন্ডিত এবং বিজ্ঞানীরা অংশ নেন। ইন্টারন্যাশনাল হিজরি ক্যালেন্ডার ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে পরিচিত এই সম্মেলনে হিজরি ক্যালেন্ডার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের মধ্যে যে বিভক্তি সেটা নিরসনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সম্মেলনে দুটি প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রথমত সারা বিশ্বের জন্য দ্বৈত বর্ষপঞ্জী চালু করা, পূর্ব গোলার্ধের জন্য একটি, আর পশ্চিম গোলার্ধের জন্য একটি। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল, সবাইকে একটি বর্ষপঞ্জীর মধ্যে নিয়ে আসা। শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞ একটি বর্ষপঞ্জীর পক্ষেই মত দেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্সি অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্সের সেসময়ের প্রেসিডেন্ট মেহমেট গোরমেজ তখন একটি তুর্কী সংবাদপত্র ডেইলি সাবাহ’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, এই নতুন বর্ষপঞ্জী মেনে নিতে কিছু দেশ হয়তো অসুবিধায় পড়বে, কিন্তু এটি যাতে বিশ্বজুড়ে গৃহীত হয় সে ব্যাপারে ওআইসি তাদের প্রভাব কাজে লাগাতে পারে।
এই সম্মেলনে বিশ্বের নামকরা পণ্ডিতরা পরামর্শ করে ঠিক করেছিলেন যে একটা দেশে চাঁদ দেখা গেলে অন্যদেশেও সেটা মানা হবে।
তবে ওআইসির এই সিদ্ধান্ত কিছু দেশ গ্রহণ করেছিল, আবার কিছু দেশ গ্রহণ করেনি।