মোদির হুমকির পরই মহারাষ্ট্রে এনসিপিতে ভাঙন

মোদির হুমকির পরই মহারাষ্ট্রে এনসিপিতে ভাঙন

ভারতের মহারাষ্ট্রে শিবসেনায় ভাঙন ধরানোর এক বছরের মধ্যে এবার ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) ভেঙে রাজ্যে জোট সরকার আরও মজবুত করে নিল বিজেপি। গতকাল রোববার বিকেলে নাটকীয়ভাবে রাজভবনে গিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এনসিপি পরিষদীয় দলের নেতা অজিত পাওয়ার। শারদ পাওয়ারের ভাইপো অজিতের সঙ্গে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আরও আট এনসিপি বিধায়ক।

অজিত পাওয়ার দাবি করেন, দলের মোট ৫৩ বিধায়কের মধ্যে তাঁর দিকে অন্তত ৪০ জনের সমর্থন রয়েছে। শপথ গ্রহণের পর তিনি বলেন, ‘গোটা এনসিপিই তাঁর সঙ্গে। দলের নাম ও প্রতীক নিয়েই তাঁরা ভোটে লড়বেন।’

অজিতের দাবি, শিবসেনার সঙ্গে জোট বেঁধে তাঁরা সরকারে ছিলেন, কাজেই বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই উচিত নয়। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কর্মযজ্ঞে শামিল হতে চান বলেই এ সিদ্ধান্ত।
লক্ষণীয়, যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ফিরে কয়েক দিন আগে মধ্যপ্রদেশে দলীয় বৈঠকে এনসিপির নাম করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দলটি ভ্রষ্টাচারে ভরা। এই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ৭০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছে। ওদের যদি দুর্নীতি করার নিশ্চয়তা থাকে, তাহলে আমিও সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের গরাদে পোরার নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’

অজিত পাওয়ার দাবি করেন, দলের মোট ৫৩ বিধায়কের মধ্যে তাঁর দিকে অন্তত ৪০ জনের সমর্থন রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ওই হুমকির দুই দিন পরই অজিত পাওয়ারের নেতৃত্বে যাঁরা সরকারে শামিল হলেন, তাঁদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে। কেউ কেউ জামিনেও মুক্ত। দলের ভাঙনের পর এনসিপি সভাপতি শারদ পাওয়ার তাই কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আমাদের তিনি দুর্নীতির সব অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দিলেন।’

কয়েক দিন আগেই শারদ বলেছিলেন, ‘এনসিপি দলটা দুর্নীতিতে শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই দুর্নীতিগ্রস্তরাই আজ তাঁর দলের আশ্রয়ে। আমরা আজ সব অভিযোগ থেকে মুক্ত হলাম।’

দেশের অধিকাংশ বিরোধী দলের অভিযোগও এক। প্রত্যেকেরই দাবি, দুর্নীতির তদন্ত ঝুলিয়ে রেখে কারাগারে পোরার ভয় দেখিয়ে বিজেপি বিভিন্ন দলে ভাঙন ধরাচ্ছে। এনসিপির ভাঙনও সেই অতি চেনা ছক।

অজিত পাওয়ার এর আগেও বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর তৎকালীন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশের ডেপুটি হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছিলেন; যদিও তিন দিনের মাথায় ফিরে এসেছিলেন দলে। তারপর ক্ষমতাসীন হয় শিবসেনা, কংগ্রেস ও এনসিপির জোট সরকার। অজিত ছিলেন সেই সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী। এক বছর আগে শিবসেনায় ভাঙন ধরিয়ে সরকার দখল করে বিজেপি। অজিতও দল ভাঙিয়ে সেই সরকারে শামিল হয়ে তৃতীয়বারের জন্য উপমুখ্যমন্ত্রী হলেন।

রাজনৈতিক মহলের জল্পনা, অজিত পাওয়ারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে শারদ পাওয়ারের হাত থাকতে পারে। কারণ, অজিত ও তাঁর সঙ্গে সরকারে শামিল হওয়া ছগন ভুজবাল, দিলীপ পাতিল, হাসান মুশরিফ, ধনঞ্জয় মুন্ডে, অদিতি তাতকারেদের বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই ইডির তদন্ত চলছে।

অজিতের সঙ্গে দলত্যাগী শারদ পাওয়ারের অতিঘনিষ্ঠ সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধেও চলছে দুর্নীতির তদন্ত। ইডির তদন্ত চলছে শারদ পাওয়ারের বিরুদ্ধেও। তদন্তে রাশ টানতে তা হলে শারদ পাওয়ারই কি অজিত-প্রফুল্লসহ ঘনিষ্ঠদের বিজেপির জোট সরকারের দিকে ঠেলে দিলেন? জল্পনা এ নিয়েও।

জল্পনা যা–ই হোক, শরদের কন্যা ও লোকসভা সদস্য সুপ্রিয়া সুলে এই ঘটনাকে ‘বিরাট ছলনা’ উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমরা দল, দলের নাম ও প্রতীক বাঁচানোর লড়াইয়ে নামব।’ ৮২ বছরের প্রবীণ শারদ পাওয়ার বলেছেন, ‘আমিই দলের সভাপতি। মানুষের সমর্থনও আমাদের দিকে রয়েছে। আমি আবার দলকে গড়ে তুলব।’

এনসিপি আজ সোমবার সকালেই মহারাষ্ট্র বিধানসভার স্পিকার রাহুল নরভেকরকে জানিয়েছে, অজিত পাওয়ারের সঙ্গে দলত্যাগী যে আট বিধায়ক মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন, তাঁদের সদস্যপদ দলত্যাগবিরোধী আইনে খারিজ করা হোক। একই সঙ্গে দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে, দলের নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শারদ পাওয়ারই দলের নেতা। অজিত শিবির সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কমিশন যেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলে।

লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের যে উদ্যোগ চলছে, এনসিপির ভাঙনে তা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হবে, তেমনি প্রশ্ন উঠবে শারদ পাওয়ারের ক্ষমতা নিয়েও। জোট গঠনে শারদ যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, প্রশ্নের মুখে পড়বে সেটাও।

আবার এটাও ঠিক, মহারাষ্ট্র সরকারে অজিত পাওয়ারের যোগদান মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। শিন্ডে গোষ্ঠীর যাঁরা সরকারের শরিক, মন্ত্রিত্ব নিয়ে তাঁদের অনেকের মধ্যেই তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। এবার অজিত পাওয়ারের দলবল যোগ দেওয়ায় সরকারের শরিক রাজনীতি কোন খাতে বইবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। দলের পরিস্থিতি আলোচনা করতে শারদ পাওয়ার ৬ জুলাই বৈঠক ডেকেছেন। সেদিনই বোঝা যাবে ৫৩ বিধায়কের কতজন তাঁর দিকে।

মহারাষ্ট্রের ঘটনাবলি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সম্ভাবনাও জোরালো করে তুলেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিজেপি ইতিমধ্যেই পুরোনো শরিকদের কাছে টেনে এনডিএ জোটকে শক্তিশালী করতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে বিজেপি কথা শুরু করেছে শিরোমণি অকালি দল ও তেলেগু দেশম পার্টির সঙ্গে। বিহার ও উত্তর প্রদেশের ছোট ছোট অথচ জাতভিত্তিক প্রভাবশালী দলকেও তারা কাছে টানছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় রদবদলের সময় প্রধানমন্ত্রী এসব দলকে গুরুত্ব দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেখানে অবশ্যই স্থান পাবে শিবসেনার শিন্ডে গোষ্ঠী ও এনসিপির প্রফুল্ল প্যাটেলের মতো কেউ কেউ।

রোববারের ঘটনাবলির পর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই শারদ পাওয়ারকে ফোন করেছিলেন। বিরোধী দলগুলোর মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কতটা ঠুনকো, কতখানি লোকদেখানো, মহারাষ্ট্র–কাণ্ড তা নতুন করে বুঝিয়ে দিল। দুর্নীতির তদন্তের নামে ইডি, সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে লেলিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বিরোধী দল ভাঙিয়ে ক্ষমতাসীন থাকতে চান, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023 EU BANGLA NEWS