কোভিড মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের জেরে মূল্যস্ফীতির সূচক যেভাবে ওপরে উঠল, তাতে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। এই বাস্তবতায় নতুন কোনো ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না।
কিন্তু ঠিক সেই বিষয়টি হঠাৎ ঘটে গেল, রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু করায়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন, রাশিয়া ১৯১৭ সালের মতো ‘গৃহযুদ্ধের’ দ্বারপ্রান্তে।
তবে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আশঙ্কা কমেছে। কিন্তু ২৩ বছরের শাসনামলে পুতিনের জন্য এটা সবচেয়ে বড় হুমকি ও চ্যালেঞ্জ, যার পরিণতিতে পরিস্থিতি আবারও টালমাটাল হতে পারে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাশিয়া বিশেষজ্ঞ জেফরি সনফিল্ড সিএনএনকে বলেছেন, পুতিন এখন চূড়ান্ত নৈরাজ্যের কবলে।
রাশিয়া এখন আর বিশ্বের শীর্ষ ১০ অর্থনীতির তালিকায় নেই। দেশটির জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের আকার অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সমান। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী তারা। রাশিয়ার তেলের ক্রেতাদের মধ্যে আছে চীন ও ভারত, যদিও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর কারণে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ভারত ও চীন পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে।
তবে রাশিয়াতে এখন যা ঘটছে তাতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ কাতার গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদ্রোহের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বলেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনে পরিস্থিতির অবনতি হলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তিতে বড় প্রভাব পড়বে, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তায়ও বড় প্রভাব পড়বে।
রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটলে ভারত ও চীনের মতো দেশ ভিন্ন উৎস থেকে জ্বালানি কিনতে বাধ্য হবে। তাতে পশ্চিমের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হবে তারা। এ ছাড়া রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে যদি খাদ্য ও সার সরবরাহ ব্যাহত হয়, তাহলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হবে। ফলাফল—এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এনার্জি আসপেক্টসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ভূরাজনীতি বিভাগের প্রধান রিচার্ড ব্রোঞ্জ সিএনএনকে বলেন, এখন বাজারের কাজ হচ্ছে, রাশিয়ার সরবরাহ ব্যাহত হলে কোন পণ্যের দাম কত বাড়তে পারে, তার হিসাব করা। আরও অনেক বিশ্লেষক একই মত পোষণ করেন।
আরেক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কেপলারের তেল বিশ্লেষক ম্যাট স্মিথ সিএনএনকে বলেন, এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা শুধু অনিশ্চয়তাই সৃষ্টি করবে, যার পরিণতিতে বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
গত বছর রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। তার জেরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এই মূল্যস্ফীতি এখন অবশ্য অনেকটাই কমে এসেছে, যদিও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই এখনো চলছে।
গৃহযুদ্ধ হলে কী হয় তার সবচেয়ে উজ্জ্বল নজির হচ্ছে লিবিয়া ও ভেনেজুয়েলা। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন এজেন্সির তথ্যানুসারে, লিবিয়া একসময় দিনে ১৭ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করত, ২০২০ সালে যা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ব্যারেল নেমে আসে। সেই বছর ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদনও কমে রেকর্ড পর্যায়ে নেমে আসে।
তবে রাশিয়াকে তেলের বাজারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় বলে মনে করে সিএনএন। তাদের দৈনিক উৎপাদন এক কোটি ব্যারেলের কিছু কম, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের ১০ শতাংশই তারা জোগান দেয়। দেশটি দৈনিক ৮০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে, ফলে সৌদি আরবের পর রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারী—তৃতীয় বা চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানিকারকদের সঙ্গে তার ব্যবধান অনেক।
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেলের দাম কমলেও দেশটির তেল বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে।
এই বাস্তবতায় অনেক বিশ্লেষক লিবিয়া ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে রাশিয়ার তুলনা করতে নারাজ; বরং তারা এই পরিস্থিতির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময়ের তুলনা করতে চান। সেই সময়ের পর রাশিয়ার তেল শিল্পের ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লেগে যায়।
ভাগনারের বিদ্রোহের কারণে কী ঘটবে, তা এখনই পুরোপুরি বলা যাবে না। উত্তেজনার অবসান এখনো হয়নি, সে কারণে পরবর্তীকালে কী ঘটবে, তা বলার এখনো সময় আসেনি। তবে সেই সঙ্গে নতুন নতুন অনেক প্রশ্নেরই উদয় হবে।