ডেঙ্গু আক্রান্ত সাড়ে সাত বছর বয়সী রুমাইসা গলাব্যথার জন্য কিছু খেতে পারছে না। শরীর দুর্বল বলে হাঁটতেও পারছে না। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ মোবাইলে ভিডিও দেখে। কিন্তু ক্লান্তি ও যন্ত্রণায় এটা করতেও বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। মা মোহসিনা বেগম খানিক আগেই রুমাইসার বয়স ভুল করে বলেছেন সাড়ে ছয় বছর, খুবই বিরক্ত হয়ে সে নিজের বয়স বলল সাড়ে সাত বছর। মেয়েটিকে একটু হাসো বলতেই খেপে গিয়ে বলল, ‘অসুস্থ মানুষ, হাসব ক্যামনে?’
আজ সোমবার দুপুরের দিকে রুমাইসার সঙ্গে কথা হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত শুধু রুমাইসা নয়, শান্তিবাগের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবাসসুম, গোপীবাগের সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মো. ফাহিম, যাত্রাবাড়ীর খাদিজাসহ কারও মুখেই হাসি নেই। মা–বাবাসহ পরিবারের বড়রা শিশুদের একটু আরাম দিতে বা মুখে একটু হাসি দেখতে নানাভাবে চেষ্টা করছেন।
বাবার কাজের সূত্রে বাবা, মা ও ভাইয়ের সঙ্গে রুমাইসা যাত্রাবাড়ী ওয়াপদা কলোনিতে থাকে। মাদ্রাসাপড়ুয়া রুমাইসাকে রোববার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার মা মোহসিনা বেগম জানালেন, তাঁর এক ছেলের বয়স সাড়ে ১০ বছর। চার বছর আগে ছেলের ডেঙ্গু হয়েছিল, তখনো ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান জানালেন, আজ হাসপাতালে মোট ৭০০ রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২৬৫। তাঁদের ৭৩ জনই এসেছেন গত ২৪ ঘণ্টায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশু রোগীর সংখ্যা ৭০। আর হাসপাতালটিতে এপ্রিল মাস থেকে আজকে পর্যন্ত ১০ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালটির শিশু ওয়ার্ডে দড়িতে সাদা কাগজ ঝুলিয়ে তাতে বড় বড় করে লিখে ডেঙ্গু, ডায়রিয়া ও অন্যান্য শিশু রোগীদের আলাদা করা হয়েছে। শয্যা না থাকায় শিশুদের চিকিৎসা চলছে মেঝেতে বিছানা পেতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু, এমনকি আলাদা নারী ও পুরুষদের ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল, কেউ মশারি টানাননি।
ডায়রিয়া ও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের একই ওয়ার্ডে রাখা প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামান বললেন, জায়গাস্বল্পতার জন্য এভাবে শিশুদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ফাহিম জানাল, তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। খাদিজা তার বাবার সঙ্গে এসেছে। বাবা হাসপাতালে ভর্তির কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খাদিজা একাই বসেছিল বিছানায়। সে জানাল, তার হাতে ক্যানুলার জায়গাটায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।
ধলপুরের লিজা আক্তার আট মাস ও চার বছর বয়সী দুই মেয়েকে নিয়ে আট দিন ধরে শিশু ওয়ার্ডে আছেন। ছোট মেয়ের ডেঙ্গু ভালো হতে না হতেই বড় মেয়ে এতে আক্রান্ত হয়েছে। বড় মেয়ের জন্য এক আত্মীয় গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের হাঁড়ি–পাতিলের খেলনা কিনে হাসপাতালে দেখতে এসেছেন। তবে খেলনা দিয়েও এই শিশুর মুখে হাসি দেখতে পেলেন না ওই আত্মীয়।
হাসপাতালটির সহযোগী অধ্যাপক নন্দিতা পাল বললেন, করোনায় বড়দের দ্রুত শারীরিক জটিলতা বাড়ে, কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে শিশুদের পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হয়। শিশুদের রক্তচাপ মাপা, স্যালাইন দেওয়া বা খাবার খাওয়ানো কঠিন। শিশুরা তাদের সমস্যার কথা সেভাবে বলতেও পারে না। তাই শিশুদের বেলায় একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে, চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নিয়াতুজ্জামানও বললেন, ডেঙ্গু রোগীর মনিটরিং ও ফলোআপের বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। আর শিশুদের বেলায় বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ওয়েবসাইটে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর সর্বশেষ তথ্য জানায়। তবে এতে রোগীদের মৃত্যু বা মোট ভর্তি রোগীর বয়স উল্লেখ থাকে না বা শিশুদের তথ্য আলাদাভাবে দেওয়া থাকে না।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা প্রথম আলোতে ছাপা হচ্ছে। শিশুদের বেলায় করণীয় নিয়ে তাঁরা প্রতিনিয়ত সতর্ক করছেন অভিভাবকদের।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী ১১ জুন প্রথম আলোতে এক লেখায় বলেছেন, ডেঙ্গু জ্বরে বেশির ভাগ আক্রান্ত হয় ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা। বর্তমানে অনেক শিশু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে সংক্রমণের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণ উপসর্গগুলো দেখা দেয়। প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনÑহঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর (প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), বমি ভাব, বমি, শরীরে র্যাশ (উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে ত্বকে লাল ফুসকুড়ি বা ৪ থেকে ৭ দিনের মধ্যে হামের মতো লাল বিন্দু), হাড়ের জোড়ায় ও মাংসপেশিতে প্রচণ্ড ব্যথা ইত্যাদি হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ। এর সঙ্গে কিছু লক্ষণ ডেঙ্গু জ্বরের ‘বিপজ্জনক চিহ্ন’ হিসেবে স্বীকৃত। যেমন পেটব্যথা, অনবরত বমি, শরীরে পানি জমা, নাক-মাড়ি থেকে রক্তপাত, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্থিরতা, ২ সেন্টিমিটারের বেশি লিভার স্ফীতি, রক্তে হিমাটোক্রিটের মান বৃদ্ধি এবং রক্তের অণুচক্রিকা (প্ল্যাটিলেট) দ্রুত কমতে থাকা।
ডেঙ্গু জ্বরের মারাত্মক চিহ্ন প্রসঙ্গে ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী জানিয়েছেন, ডেঙ্গু জ্বরের পাঁচ থেকে সাত দিন সময়কালে ‘মারাত্মক’ চিহ্নগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (যা ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়), শরীরে পানি জমা, নাড়ি দুর্বল, শরীর শীতল হওয়া, রক্তচাপ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত, লিভারের এনজাইম এএসটি বা এএলটির মান ১ হাজার বা এর বেশি হওয়া, অচৈতন্য অবস্থা, হৃৎপিণ্ড ও অন্যান্য অঙ্গে রোগের লক্ষণ ইত্যাদি।
অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, জ্বর সম্পূর্ণ নেমে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর যদি রোগী বেশি অসুস্থতা বোধ করে, তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি। প্রয়োজনে রক্ত বা প্লাজমা সঞ্চালন এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের বিশেষ চিকিৎসা নিতে হবে। একসঙ্গে একাধিক অঙ্গের বিকলাবস্থা (পিএমআইসি), চিকিৎসাকালীন ওভারহাইড্রেশন এবং ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা শিশুর জন্য ডেঙ্গু বেশি প্রাণঘাতী। শিশুকে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পরানোর পাশাপাশি দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন এ চিকিৎসক।
১৯ জুন প্রথম আলোতে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাসোলিনের ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার রাহানুমা আমিন এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, জ্বর হলে শিশুদের পরিপূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। শিশুকে পর্যাপ্ত পানি, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি পান করাতে হবে, যেন অন্তত ৬ বার করে প্রস্রাব করে। জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ দেওয়া যাবে না। কুসুম গরম পানি দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে ডেঙ্গুর বিপদচিহ্নগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।