পর্দায় হাসিখুশি থাকলেও ব্যক্তিজীবনটা ছিল একেবারেই আলাদা। লন্ডনের ওয়ালওর্থে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হতে হয়েছে। ৯ বছর বয়সেই অর্থকষ্টে অভিনয়ে নাম লেখাতে হয়েছে। এরপর দীর্ঘ এক যুগ ধরে একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর নাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যেই আলোচিত চার্লি চ্যাপলিনকে হঠাৎ বিয়ে করতে হয়।
১৯১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি প্রথম বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। এরপরে একে একে চারবার বিয়ে করেন। এর মধ্যে তিনজনই ছিলেন অভিনেত্রী। আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, তাঁদের কারও কাছ থেকে তিনি শান্তি পাননি। সর্বশেষ তিনি ৫৪ বছর বয়সে ১৬ জুন আজকের দিনে বিয়ে করেন উওনা ও’নিলকে। নানা বিতর্কের মধ্যে এই বিয়ে তাঁকে কীভাবে সুখী করেছিল, সেটাও যেন সিনেমার মতোই গল্প।
১৯১৫ সালের দিকে তুমুল আলোচিত নাম চার্লি চ্যাপলিন। তখন একনামে তিনি পরিচিতি পাচ্ছেন। তখন তিনি পরিচালনায় সবে প্রবেশ করেছেন। কোনো কোনো কাজে পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম না গেলেও অভিনেতা হিসেবে ‘আ নাইট আউট’, ‘আ ওমেন’, ‘দ্য ভ্যাগাবন্ড’, ‘পুলিশ’, ‘দ্য ইমিগ্রান্ট’সহ একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা দেয়। একের পর এক লিখেছেন চিত্রনাট্য।
সেই সময় তাঁর পরিচয় হয় অভিনেত্রী মিলড্রেড হ্যারিসের সঙ্গে। তখন এই অভিনেত্রীর বয়স ১৭ বছর। চ্যাপলিনের বয়স ছিল ২৭। তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। হঠাৎ একদিন এই অভিনেত্রী জানান, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। ১৯১৮ সালের হ্যারিসকে বিয়ে করেন চ্যাপলিন। এই বিয়েতে সুখী ছিলেন না চ্যাপলিন। বোঝাপড়া নিয়ে তাঁদের সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে। এর মধ্যেই চ্যাপলিন জানতে পারেন, হ্যারিসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরটি সত্য নয়। এটা ছিল বানোয়াট। এই মিথ্যা আর বেশি দিন চলতে দেননি তিনি। সিদ্ধান্ত নেন বিবাহবিচ্ছেদের। ১৯২০ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদের পরে অনেকটাই একা হয়ে যান এই অভিনেতা। তবে নিয়মিত ভালো কাজ করে গেছেন। যে কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ১৯২৪ সালে ‘দ্য গোল্ড রাশ’ সিনেমার শুটিংয়ের সময়ে অভিনেত্রী লিটা গ্রের সঙ্গে চ্যাপলিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও তখন লিটা গ্রের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এর আগে ১৯২১ সালে এই লিটাই চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’ সিনেমায় শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই লিটার প্রেমে পড়ে যান চ্যাপলিন। অবশেষে বিয়ে করেন তাঁরা। তখন চ্যাপলিনের বয়স ৩৫ বছর। এবারও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে তাঁরা ১৯২৭ সালে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।
দ্বিতীয় বিয়ে বিচ্ছেদের পরে কিছুটা থমকে গিয়েছিলেন চ্যাপলিন। একের পর এক কাজ করে যাওয়া চ্যাপলিন কাজের সংখ্যা কমিয়ে দেন। তবে দ্বিতীয় বিচ্ছেদের পরে ৯ বছরে ‘দ্য সার্কাস’, ‘সিটি লাইটস’, ‘মডার্ন টাইম’-এর মতো কাজগুলো তাঁর পরিচিতি আরও বেশি বাড়িয়ে তোলে। এর মধ্যে ‘মডার্ন টাইমস’–এর শুটিংয়ে তাঁর সঙ্গে জুটি হন আরেক অভিনেত্রী পলেট গডার্ড। তিনিও তখন একা ছিলেন। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল পলেটের। ১৯২৭ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত টিকেছিল সেই সংসার। বিচ্ছেদ নিয়ে চ্যাপলিন ও পলেটের তখন বিরূপ অভিজ্ঞতা। দুজনই পোড় খাওয়া, তাঁরা প্রেমে পড়েন পরস্পর। পরবর্তী সময়ে বিয়ে নিয়ে তাঁরা দোটানায় ছিলেন। ১৯৩৬ সালে ‘মডার্ন টাইম’–এর শুটিংয়ের সময় তাঁরা এক হয়ে গেলেন। প্রেম বেশি দিন চলতে দিলেন না কেউ। বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তাবলি, স্বাধীনতাসহ আরও বেশ কিছু শর্ত দিয়ে পরের বছরই তাঁরা বিয়ে করেন। চ্যাপলিনের তৃতীয় স্ত্রী হলেন পলেট গডার্ড। দুজনের সংসার ভালোই চলছিল। দুজন ‘গ্রেড ডিক্টেটর’-এ অভিনয় করেন। কিন্তু তিন বছর পরেই সংসারে অশান্তি শুরু হয়। গডার্ডের সঙ্গে ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি হয়।
তিন বিচ্ছেদের পরে এবার প্রেম করে বিপাকে পড়তে হয় চ্যাপলিনকে। ১৯৪২—তৃতীয় বিচ্ছেদের পরে চ্যাপলিনের উঠতি অভিনেত্রী জোন ব্যারির সঙ্গে পরিচয়। ব্যারি চ্যাপলিনের সিনেমায় অভিনয় করতে চাইতেন। এভাবেই তাঁদের পরিচয়। পরে দুজনই প্রেমে জড়ান। দুই বছর তাঁদের প্রেম ভালোই চলছিল। এর মধ্যে ব্যারি মা হন। তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে ব্যারি চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে তাঁর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্বের অধিকার চেয়ে মামলা করেন। পরে কোর্ট চ্যাপলিনকে সন্তানের বাবা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সন্তানের ভরণপোষণের নির্দেশ দেন। সেই সময় চ্যাপলিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনায় পড়ে যান। ক্যারিয়ারে সফলতা ও ব্যক্তিজীবনে বিতর্ক যেন একই সঙ্গে এগোতে থাকে। এরপরে কাজে লম্বা বিরতি দেন মানুষ হাসানো চ্যাপলিন। টানা ছয় বছর তিনি আর কোনো সিনেমা নির্মাণ করেননি।
সেই সময়ে চ্যাপলিন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে থাকেন। এদিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল। এই ঘটনা তখন পুরোনো। এ কারণে তাঁকে সব সময় নজরে রাখেন এফবিআই। সেই সময় চ্যাপলিনের কোনো ভুল পেলেই তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করত এফবিআই। এ কথা চ্যাপলিনই লিখেছেন। জানা যায়, ব্যারি যখন মামলা করেন, সেই মামলার দায়িত্ব নেয় এফবিআই। ব্যারির মামলার সঙ্গে চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে আরও চারটি অভিযোগ আনে এফবিআই। এসব মামলার মধ্যে ছিল রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নারী পাচারসংক্রান্ত ঘটনাও। যে কারণে চ্যাপলিনকে ঘিরে সমালোচনাই তখন বাতাসে উড়ছিল।
তিন বিচ্ছেদের পরে আবার নতুন করে বসন্তের দেখা পান। থেমে না থাকা চ্যাপলিনের সামনে তখন ১৮ বছরের উওনা ও’নিল। জীবনের প্রেম–বিয়ে নিয়ে বারবার ভুল আর বিতর্ক নিয়ে হতাশ ও বিরক্ত ছিলেন চ্যাপলিন। এবার হয়তো আর বোঝাবুঝির মধ্যে ছিলেন না। খুব অল্প সময়ে উওনা ও’নিলের প্রেমে পড়ে যান। ৮০ বছর আগে আজকের দিনে, অর্থাৎ ১৬ জুন তাঁরা বিয়ে করেন। এই বিয়ে নিয়ে যখন নানা কথা শুনতে হচ্ছিল, তখন নিজেকে উজাড় করে গণমাধ্যমে জানালেন, ‘জীবনের সেরা সুখ খুঁজে পেয়েছেন। উওনা ও’নিলের মধ্যে তিনি সত্যিকার জীবন খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা যেন এক আত্মা হয়ে গিয়েছিলেন। চ্যাপলিনের ৫৪ ও উওনা ও’নিলের ১৮ বছর বয়স কোনো বাধা হতে পারেনি।’
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। তখন চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে সাবেক স্ত্রীর মামলা চলছিল। একই সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নারী পাচারসংক্রান্ত মামলায় দিশেহারা ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা। মামলার এই সময়ে সম্পূর্ণভাবে চতুর্থ স্ত্রীকে পাশে পেয়েছিলেন চ্যাপলিন। শুধু সেই সময়ই নয়, পরবর্তী জীবনেও যখন চ্যাপলিন নির্বাসিত হন, তখনো এই স্ত্রীকে পাশে পেয়েছিলেন। শতভাগ তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। চ্যাপলিন তাঁর আত্মজীবনী ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বইতে লিখেছেন, “ও’নিলের সঙ্গে সংসার করার দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। তার মধ্যেই আমি ভালোবাসা, বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আমরা দুজনই দুজনকে বোঝার চেষ্টা করেছি।’
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদের প্রথম পরিচয় হয় ‘শ্যাডো অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স’ নামের একটি সিনেমার গল্প নিয়ে কথা বলার সময়ে। যদিও সেই সিনেমাটি কখনোই নির্মিত হয়নি। পরে হাতে গোনো কয়েকটি কাজ করেছেন চ্যাপলিন। সেই সময়েই ‘লাইম লাইট’ সিনেমার জন্য একমাত্র অস্কার জয় করেন চ্যাপলিন। কাজের পাশাপাশি পরিবারকেই তিনি বেশি সময় দিয়েছেন। চ্যাপলিনের মৃত্যুর আগপর্যন্ত ও’নিল তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় আট সন্তান।