আইনস্টাইন বলেছেন, স্থান, কাল ও ভর—এই তিনটির কোনোটিই নিরপেক্ষ বা পরম কিছু নয়। এগুলো হলো আপেক্ষিক জিনিস।
এই তিন জিনিসের প্রতিটিই অন্য কোনো কিছুর সাপেক্ষে বিবেচিত হয়। অন্য কোনো কিছুর সাপেক্ষে এই বিষয়গুলো বিবেচিত হওয়ার নামই হলো আপেক্ষিকতা।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার এই তত্ত্বমতে, পরম গতি বলে কিছু নেই, সব গতিই আপেক্ষিক।
কাউকে চড়–থাপ্পড়–ঘুষি মারলে সেই চড়–থাপ্পড়–ঘুষির যে গতি থাকে, সেটিও কিন্তু আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মধ্যে পড়ে। এই তত্ত্ব বলছে, যাকে থাপ্পড় মারা হলো, তার অবস্থান থেকে সেই থাপ্পড়ের গতি এক রকম; আর যিনি মারলেন, তাঁর অবস্থান থেকে সেই গতির মাপ আরেক রকম। যে মারে তার কাছে যা সামান্য পিটুনি, যে মার খায় তার কাছে তা ‘অ্যাটেম্পট্ টু মার্ডার’।
এই জটিল আইনস্টাইনীয় তত্ত্ব আমাকে বছর বিশেক আগে পানির মতো পরিষ্কার করে বুঝিয়েছিল যাত্রীবাহী একটি বাসের কিশোর বয়সী একজন হেলপার।
একবার এক হাইওয়েতে বাসে যাওয়ার সময় চলন্ত বাসের পাদানিতে দাঁড়ানো হেলপার রাস্তায় দাঁড়ানো এক ছেলের গালে চড় বসিয়ে দিল। ছেলেটা রাস্তার পাশে ছিটকে চলে গেল। হেলপার ড্রাইভারকে বলল, ‘ওস্তাদ, কত কিলো গতিতে আছি।’ ড্রাইভার বললেন, ‘ষাইট কিলো।’
হেলপার ছেলেটা বলল, ‘ষাইট কিলো গতিতে চড় দিছি। হাতটা ধইরাই রাখছিলাম। অর পাতানো গালে যাইয়া পড়ছে। আমি তো রানিং বাসে খাড়ানো; আমার কাছে এই চড়ের গতি এক কিলোও না, কিন্তুক চড়ডা যে খাইছে, তার কাছে এই চড়ের গতি পাক্কা ষাইট কিলো।’
আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এমন সরলসোজা ব্যাখ্যায় আমি বোবা হয়ে গেলাম।
২০ বছর পর ফের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আরেকটি ‘রক্তবৎতরলং’ ব্যাখ্যা শুনলাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছ থেকে। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়রপ্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করিমের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করার পর সিইসি প্রায় সেই ধরনের একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সোমবার ভোট গ্রহণের সময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা ফয়জুল করিমের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক যুবককে ফয়জুল করিমের দিকে চেয়ার ছুড়ে মারতে দেখা গেছে। এরপর ফয়জুল করিমকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। এ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয় নিয়ে ঢাকায় সাংবাদিকেরা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে তিনি বলেছেন, ফয়জুলের রক্তাক্ত হওয়ার বিষয়টি ‘আপেক্ষিক’।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এবং সেই বাস-হেলপারের তত্ত্বের আলোকে সিইসির এ কথা বিবেচনা করলে তার মানে দাঁড়ায়, ফয়জুল করিম কতটা রক্তাক্ত হয়েছেন, তা তাঁর (ফয়জুলের) জায়গা থেকে এক রকম এবং সিইসি কিংবা ক্ষমতাসীন দল কিংবা অন্যদের জায়গা থেকে আরেক রকম মনে হবে। অর্থাৎ কিনা—‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’।
সিইসি সাংবাদিকদের সামনে বলেন, —
‘এটা হলো…রক্তাক্ত…সবকিছু আপেক্ষিক। উনি (ফয়জুল করিম) কি ইন্তেকাল করেছেন? না, উনি কি…?…কতটা?…আপনার…আমরা দেখেছি…আমরা ওনার রক্তক্ষরণটা দেখিনি। যতটা শুনেছি ওনাকে…শুনেছি, ওনাকে কেউ পেছন দিক থেকে ঘুষি মেরেছে। কাজেই…ওনার বক্তব্যও শুনেছি। উনিও বলেছেন, “ভোট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না, আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভোট কার্যক্রম ওই কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে কি না…আমরা যে খবর পেয়েছি, …যে ভোট কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়নি। ওনাকে যে আহত করা হয়েছে, আমাদের এখান থেকে সুস্পষ্ট…সঙ্গে সঙ্গে আমরা…সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। পুলিশের কমিশনার, জেলা প্রশাসক, রিটার্নিং অফিসার এবং যে দায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নিয়েছে।’
সিইসির উপরিউক্ত ‘ডটবহুল’ কথাগুলো থেকে বোঝা যায়, তিনি দাঁড়ি (যতিচিহ্ন অর্থে) বসানো সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ বাক্যে কথা বলেননি। বারবার থেমেছেন। বাক্য শেষ না করে নতুন বাক্যে ঢুকে পড়েছেন।
ধারণা করি, মিডিয়ার সামনে অধিক সাবধান হয়ে কথা বলতে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে। তবে এই বক্তব্যের মর্মার্থ হিসেবে এটি সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে ফয়জুল করিমের রক্তাক্ত হওয়ার বিষয়টি ফয়জুল বা তাঁর কর্মী-সমর্থকদের কাছে যতটা গুরুতর মনে হচ্ছে, ইসির কাছে ততটা মনে হচ্ছে না।
একইভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত যদি ফয়জুলের অনুসারীদের হামলায় রক্তাক্ত হতেন তাহলে তার ‘গ্র্যাভিটি’ হতো অন্য রকম। এতক্ষণে হয়তো হামলাকারীদের ধরেটরে তাদের দফারফা করে ফেলা হতো। ফলে এখানে বিষয়টা আসলেই ‘আপেক্ষিক’।
‘উনি কি ইন্তেকাল করেছেন?’—সিইসির এই সারল্যসঞ্জাত প্রশ্নের মধ্যেই (ক্ষমতাসীন দলের বাইরের) একজন প্রার্থীর জখম হওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের উতলা না হওয়ার সানুনয় আহ্বান নিহিত আছে।
‘ইন্তেকাল করলে হয়তো ওনার (সিইসির) কানে পানি যেত, এই তো! যেহেতু রক্তাক্ত হইছি, অ্যাসাল্ট হইছি, এই জন্য মনে হয় ওনার আশা পুরা হয় নাই। ইন্তেকাল করলে মনে হয় যেন ওনার আশা পুরা হইত।’
ফয়জুল করিমের জখম হওয়া প্রসঙ্গে সিইসি কেন ‘ইন্তেকাল’ শব্দটি ব্যবহার করলেন, সেটির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
কেউ হামলায় জখম হওয়ার পর মারা গেলে আমরা সাধারণত বলি, ‘তিনি নিহত হয়েছেন’ বা ‘তিনি মারা গেছেন’। কিন্তু ‘তিনি দুর্বৃত্তের হামলায় ইন্তেকাল করেছেন’—এমন কথা কাউকে বলতে অন্তত আমি শুনিনি। যেহেতু ফয়জুল করিম একজন ধর্মীয় নেতা ও পীর, সে কারণেই কি সিইসি তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান দেখিয়ে ‘ইন্তেকাল’ শব্দটি ব্যবহার করলেন?
সিইসির এই বক্তব্যে ফয়জুল করিমের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ভাষ্য ছিল, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’
হামলার ঘটনা বলতে গিয়ে ফয়জুল করিম সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘এই যে দেখেন না, ঠোঁট ফাটা, নাক দিয়ে রক্ত পড়তেছে, দাঁত নড়ে গেছে।’
এ সময় একজন সাংবাদিক ‘সিইসি তো বলেছেন, উনি ইন্তেকাল করেননি…’ বলার পর ফয়জুল করিম বলেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’ তিনি বলেন, ‘ইন্তেকাল করলে হয়তো ওনার (সিইসির) কানে পানি যেত, এই তো! যেহেতু রক্তাক্ত হইছি, অ্যাসাল্ট হইছি, এই জন্য মনে হয় ওনার আশা পুরা হয় নাই। ইন্তেকাল করলে মনে হয় যেন ওনার আশা পুরা হইত।’ এরপর তিনি বলেন, ‘আমি বুঝছি, এইটা নির্বাচন না, একটা সাজানো নাটক ছিল।’
ফয়জুল করিমের বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অবশ্য তাঁকে নিয়ে ট্রল করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, ‘যদি এটা সাজানো নাটক হয়ে থাকে, তাহলে তিনি নিজেও সেই নাটকের একজন অভিনেতা।’
এর ব্যাখ্যা হিসেবে তাঁরা বলছেন, ক্ষমতাসীনেরা ভোটকেন্দ্র দখল করবেন—এ আশঙ্কায় যখন বিএনপিসহ অন্যরা ভোট বয়কট করল, তখন ক্ষমতাসীন দলের এই নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার সহযোগী শক্তি হিসেবে ফয়জুল করিম ভোটে দাঁড়ালেন। এখন যা ঘটেছে, তা যে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা অনেকেই মনে করছেন না। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ট্যাটাস-মন্তব্যে তাই দেখা যাচ্ছে।
তবে নির্বাচন নিয়ে সিইসির বক্তব্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
গত শনিবার সিলেটে গিয়ে তিনি ভোটারদের ভোট না দিতে পারলে ‘চিৎকার দিতে’ বলে এসেছেন। সেই চিৎকার শুনে ঢাকায় বসে ইসি ব্যবস্থা নেবেন বলেও ভোটারদের আশ্বাস দিয়েছেন।
মেন্দিবাগে জালালাবাদ গ্যাস অডিটোরিয়ামে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচন উপলক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকায় বসে সিসিটিভির মাধ্যমে সব কেন্দ্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব। কোনো ভোটার যদি ভোট দিতে না পারেন, তাহলে আপনারা চিৎকার দেবেন। আমরা কেন্দ্র (ঢাকা) থেকে ব্যবস্থা নেব।’
একই অনুষ্ঠানে ইভিএম নিয়ে বলেন, ‘ইভিএমের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। অনেকে এর ভেতরে ভূতপ্রেত অনেক কিছু থাকার কথা বলেছেন। আমরা খুঁজতে গিয়ে কিছু পাইনি। অনেক ওঝা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করেও কোনো রকম ভূতপ্রেত পাওয়া যায়নি।’
নানা অভিযোগের পরও বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষে ঢাকায় সাংবাদিকদের সামনে ঠিক পূর্বসূরিদের মতো নির্বিকারভাবে বলেছেন, ‘সার্বিক অর্থে সুন্দর ও সুচারুভাবে নির্বাচন হয়েছে। কমিশন সন্তুষ্ট।’
কিন্তু সিইসি সম্ভবত জানেন, কিন্তু মানেন না—প্রার্থীর রক্তাক্ত হওয়ার বিষয়টি যতটা না আপেক্ষিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আপেক্ষিক হলো ‘সুন্দর ও সুচারু নির্বাচন’।
একের পর এক অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনগুলো সিইসির কাছে ‘সুন্দর ও সুচারু’ হতে পারে, কিন্তু বাকি লোকদের কাছে তা কী, সেটি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ওপর ভর করে সিইসির একবার খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত।